মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
২৮ মে ২০২৫, ০৮:৫৭ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গত প্রায় দশ মাসে দেশে আন্দোলনের যেন জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। শত শত আন্দোলন মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই সরকারকে। ব্যতিক্রম নয় দেশের শিক্ষাঙ্গনও। সামগ্রিক আন্দোলন ও অস্থিরতার একটা প্রভাব তো শিক্ষা খাতে পড়ছেই। পাশাপাশি নানা ইস্যু তৈরি করে, যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলনে অস্থির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবখানেই লেগেছে আন্দোলনের এই ঢেউ।
শিক্ষাবিদরা আশঙ্কা করছেন, এই অস্থিরতার কারণে শিক্ষা খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে দেখা দিতে পারে সেশনজট। বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে শিক্ষা খাত।
শিক্ষাবিদরা জানান, শিক্ষার এমন সংকট নিরসনে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। কেবল কোনো ঘটনা ঘটলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তারা সরকারকে এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। একটি কমিশন করে শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা আনার পরামর্শও দিচ্ছেন কেউ কেউ।
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবির আন্দোলন
১১তম গ্রেডে বেতনসহ তিন দফা দাবিতে গত সোমবার (২৬ মে) থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা টানা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এর আগে গত ৫ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মদিবসে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা। পরে ১৭ মে থেকে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি করেন।

মঙ্গলবার (২০ মে) বিকেলে রাজধানীর মিরপুরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সম্মেলনকক্ষে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান।
এ বিষয়ে ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’-এর নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, আমাদের দাবি মেনে নিলেই আমরা আবার শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরবো। দাবি পূরণের আগ পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) সঙ্গে সভার বিষয়ে তিনি বলেন, সভা অনেকটা সফলই। অধিদফতর থেকে আমাদের দাবির ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের দাবি জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাস হতে হবে। আমরা সেটাই চাই।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন
শিক্ষা জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে গত ১৭ মে থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। গত বুধবার (২১ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ‘লংমার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচির দিন শিক্ষকদের দুই পক্ষের বাকবিতণ্ডা হয়। এতে ঐক্য পরিষদের সভাপতিকে ‘দোসর’ আখ্যা দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন এক পক্ষের শিক্ষকরা। এই ঘটনার পর শিক্ষকদের আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, আমাদের আন্দোলন সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রয়েছে। তবে আন্দোলনের বিষয়ে মিটিং হবে। তারপর হয়তো ঈদের পর আবার আমরা আন্দোলন শুরু করবো।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা
তিন দফা দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার পাশে টানা ৫০ ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে গত ১৬ মে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ এসে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত করেন তারা।
সার্বিক বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতা কেটে গেছে। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি চলছে। এছাড়া দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের প্রকল্প দ্রুতই পাস হচ্ছে বলেনও জানান তিনি।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয় সরকার। এরপর ১ মে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক মো. হযরত আলীকে কুয়েটের অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে নিয়োগের তিন সপ্তাহের মাথায় পদত্যাগ করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অন্তর্বর্তী উপাচার্য অধ্যাপক মো. হযরত আলী। বর্তমানে শিক্ষকদের আন্দোলনে অচলাবস্থার মধ্যে গত বুধবার তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে কুয়েটের অবস্থা এখনো স্থিতিশীল হয়নি।

গত ৪ মে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা আমরণ অনশনে বসেন। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে গত ১৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনসহ উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
সংকট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। চলতি বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা দাবিতে আন্দোলন করছেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন এখনো অব্যাহত আছে।
গত ২৬ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য, সব ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা পদত্যাগ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৮ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি চিঠি ইস্যু করে। সেখানে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে যারা অসন্তুষ্ট বা নারাজ, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হবে। সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পারা শিক্ষার্থীরা ভর্তি বাতিলের জন্য আবেদন করলে তাদের চলতি সেমিস্টারের ফি ফেরত দেওয়া হবে। তবে এই চিঠির প্রতিবাদও জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি।
তুচ্ছ ঘটনার জেরে গত ১৯ এপ্রিল প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পারভেজকে নিজেদের কর্মী এবং হত্যকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতা জড়িত দাবি করে আন্দোলনে নামে ছাত্রদল। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। তবে অস্থিরতা এখনো কাটেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নানান অজুহাতে চাকরিচ্যুত করার অসংখ্য অভিযোগ তোলেন তারা।

সাত কলেজ নিয়েও আছে সংকট
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত ইউজিসির তত্ত্বাবধানে সমন্বিত কাঠামোর অধীন চলবে ঢাকার সরকারি সাত কলেজের কার্যক্রম। অন্তর্বর্তী এই ব্যবস্থায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে কাজটি আটকে ছিল। এ নিয়ে গত শনিবার আবারও আন্দোলনের হুমকি দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এ রকম পরিস্থিতিতে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াসকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে তাকে আগামী দুই বছরের জন্য ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গত রোববারই প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
অভিযোগ উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়েছিল, কিন্তু প্রশাসক পদে মিরপুর বাঙলা কলেজের একজন শিক্ষকের চেষ্টা ছিল। মূলত এ কারণেই বিষয়টি আটকে ছিল।
এদিকে সাত কলেজ নিয়ে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, সাত কলেজ থেকে তিতুমীরকে আলাদা করে স্বতন্ত্র কাঠামো গঠনের মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এর আগে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে টানা কয়েক দিন আন্দোলন করেন।
আরও পড়ুন
সুখবর পেলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা
গতকাল সোমবার (২৬ মে) কারিগরি শিক্ষার্থীদের ছয় দফার আন্দোলন শেষ হয়েছে। এর আগে প্রায় দুই মাস ধরে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ ও শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন তারা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অস্থিরতা ও স্থবিরতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে শিক্ষার সব প্রতিষ্ঠানে যেভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে দেশটা যে কোন দিকে যাচ্ছে বোঝাই কঠিন। নতুন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে এটির ফলে প্রাথমিকের শিক্ষা কার্যক্রম একেবারে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তবে সরকারের উচিত শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দেওয়া, যাতে কারো আন্দোলনে যেতে না হয়। আর যদি সেটা বিভিন্ন কারণে দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের বলে দিতে হবে।’
এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষকদের উচিত পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত না করা। শুধু নিজেদের স্বার্থ সব সময় দেখলে চলবে না। শিক্ষকরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।’
বর্তমান অন্তর্বতী সরকার নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে। শিক্ষার সংস্কারের জন্য আলাদা একটি কমিশন প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
শিক্ষাঙ্গনে এই অস্থিরতা সম্পর্কে কথা বলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে কেউই সাড়া দেননি।
এএসএল/জেবি