মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
০৬ আগস্ট ২০২২, ০২:১১ পিএম
দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে একেবারেই অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একলাফে এত দাম বৃদ্ধি করা ঠিক হয়নি। এটা জনসাধারণের জন্য যেমন ভোগান্তি, সরকারের জন্যও বিব্রতকর। এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব সরকারের ওপরও পড়বে। এছাড়া এই মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে। ইতোমধ্যে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়তে শুরু করেছে।
গতরাতে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর পর সকাল থেকে রাজধানীতে কমে গেছে গণপরিবহন। এতে কর্মজীবীসহ সাধারণ মানুষ পড়েছেন ভোগান্তিতে। আর বাস সংকটের এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন সিএনজি অটোচালক। পিছিয়ে নেই রিকশা চালকরাও। তারও সুযোগ কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত দাম চাচ্ছেন।
জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা খুবই অযৌক্তিক একটা সিদ্ধান্ত। সরকার যেটা দাম বাড়িয়েছে এটা কোনোভাবে সহনীয় পর্যায়ে নয়। ১০-২০ শতাংশ হলে আলাদা কথা ছিল। কিন্ত সরকার যেটা বাড়িয়েছে এটা অযৌক্তিক হয়েছে। কারণ মহামারির পরে আমাদের যে দুর্যোগটা গেল আমাদের উপরে অলরেডি মানুষের ওপর আর্থিক সংকটের বোঝা চেপে আছে। তার উপরে এত বড় একটা বোঝা চাপানো ঠিক হয়নি।’
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যে কারণেই সরকার দাম বৃদ্ধি করুক না কেন, এক লাফে রাতারাতি যদি এই ধরনের মূল্য বৃদ্ধি হয়, আপনাকে দেখতে হবে ভোক্তা পর্যায়ে যে আমি এটা দিলাম, সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে। আমাদের দেশের মানুষ তো সাধারণভাবে, আর্থিকভাবে অসচ্ছল। এই অসচ্ছল জনগোষ্ঠীকে যদি হঠাৎ করে এত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দেন, তাহলে এটা যৌক্তিক।’
আরও পড়ুন: তেল নিয়ে হিসাব মিলছে না বিশেষজ্ঞদেরও!
একলাফে এত দাম বৃদ্ধি সরকারের জন্যও বিব্রতকর উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটা সরকারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দাম বাড়ানোর সাথে সাথেই দেখেন অনেক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ। এর মানেই জনজীবনে একটা ভোগান্তি। সমস্ত ভোগান্তি এভাবে ছেড়ে দেওয়াটা সরকারের জন্যও বিব্রতকর। এই সময়টা নির্বাচনের আগের বছর। এই সময় সরকার বুদ্ধি করে কেন সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপগুলো নিলো না, সেটাই আমার প্রশ্ন। আমার মনে হয়, সরকার এটাকে যদি পুনর্বিবেচনা করে, এটা সরকারের জন্য ভালো হবে।’
জ্বালানি তেলের এই দাম সার্বিকভাবেই সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন এবিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার যে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিবেচনায় সর্বোচ্চ। যার ফলে সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়। মূলত ডিজেলের ব্যবহার যে খাতগুলোতে বেশি হয়, পরিবহন ও কৃষি খাতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে, সে সমস্ত ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার উপরে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া আসবে। ডিজেলের ব্যবহারের ফলে পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা কীভাবে মূল্য নির্ধারণ করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রতিক্রিয়া কতটুকু পড়বে। আমার মনে হয়, এর প্রতিক্রিয়া সাথে সাথেই পড়তে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কৃষির ক্ষেত্রে বোরো ধানের এবং অন্যান্য উৎপাদনের যে সেচের ব্যবহার, এতে একটা প্রভাব পড়বে। ফলে ফসল শাকসবজির দামের ওপর একটা প্রভাব পড়বে। এরপর ডিজেল ব্যবহার করে যেসব কারখানায় উৎপাদন করা হয়, সেখানেও এর একটা প্রভাব পড়বে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।’
এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতিজনিত যে প্রতিক্রিয়া রয়েছে দেশের ভেতরে, সেই মূল্যস্ফীতিকে আরও কিছুটা উস্কে দেবে। তবে যে কারণে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে দাতা সংস্থাদের সাথে ঋণের আলোচনার শর্ত হিসেবে, আমার মনে হচ্ছে তা ভোক্তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যথাযথ হয়নি। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উচিত ছিল, যে সমস্ত কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, বিশেষ করে বিপিসির ক্ষেত্রে সরকার যে উদ্বৃত্ত অর্থ প্রতি বছর নিয়ে নেন, সে অর্থ যদি অর্থ মন্ত্রণালয় না নিতো তাহলে বিপিসি তার নিজস্ব অর্থেই এই মুহূর্তে তার ব্যয় মিটাতে পারত। সুতরাং সরকার যদি বিপিসির সেই অর্থ নেওয়া বন্ধ রাখে, তবে বিপিসি তার নিজের অর্থ দিয়েই এই মুহূর্তে ব্যয় মিটাতে পারত। সুতরাং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি না করলেও চলত। আরেকটা বিষয়, বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও যদি এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত আসে, সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয় ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে বরং উচিত ক্যাপাসিটি চার্জ বা ক্যাপাসিটি পেমেন্টের মতো জায়গায় থেকে সরে আসার জন্য কৌশল খোঁজা। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খোঁজা সরকারের জন্য এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
আরও পড়ুন: সংসার চালানোর ‘নতুন ছক’ কষছে মানুষ
বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী না এরপরও এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে এসব তেলের দাম বেড়েছে, তাই বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। কথাটা বিভিন্ন দিক থেকে ভুল। প্রথমত, এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী না, বরং নিম্নমুখী। দ্রুত তেলের দাম কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এর আগে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল তখন সরকার কয় বছরে লাভ করেছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা, গত কিছুদিনে যে লোকসান হয়েছে, তার তুলনায় এই লাভ কয়েকগুণ বেশি। তার মানে সরকার জনস্বার্থ ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে লাভের টাকার একাংশ দিয়েই এই লোকসান ঠেকাতে পারতো। তৃতীয়ত, দাম বাড়ালে যে ভয়াবহ পরিণতি হয় তার কথা চিন্তা করে বহু দেশেই তেল আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে দাম কম রাখতে চেষ্টা করছে।’
এদিকে, নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলে সমন্বয় করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে। জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে। যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।’
গতরাতে (৫ জুলাই) জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একলাফে লিটারে ৩৪ টাকা করে বাড়ানো হয়। নতুন করে ডিজেল ও কেরোসিন এখন ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকা করে। অন্যদিকে অকটেনে প্রতি লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৪৬ টাকা। এখন প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ এবং পেট্রোল ৪৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার। এই হিসাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ আর অকটেন-পেট্রোলে বেড়েছে ৫১ শতাংশ।
টিএই/জেবি