মহিউদ্দিন রাব্বানি
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০ এএম
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি ক্রেতারা অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। পাম্পগুলোর বিরুদ্ধে মাপে তেল কম দেওয়ার অভিযোগ পুরোনো হলেও মিলছে না সুরাহা। এতে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ক্রেতারা। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর ও সায়েদাবাদ এলাকায় বেশ কয়েকজন গাড়িচালক অভিযোগ করেছেন যে, পাম্পে প্রদর্শিত লিটার অনুযায়ী তেল দেওয়া হলেও প্রকৃত লিটার কম ঢোকানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ পেট্রোল পাম্পেই পরিমাণে কম দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, দেশের পেট্রোল পাম্পগুলো আগে তেলে ব্যাপক পরিমাণ ভেজাল দিতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। আর এ কারণে এখন আর ভেজাল দিতে পারে না পাম্প মালিকরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অভিযান পরিচালনায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা আসে। তারা ওজন মাপার যেসব মেশিন নিয়ে আসেন সেগুলোর সঙ্গে আমাদেরগুলোর অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এ কারণেই মাপে সমান হয় না। আমরা আমাদের পরিমাপক মেশিন অনুযায়ী ঠিকই দিচ্ছি।
রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা স্বপন হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, পাম্পগুলো তেল কম দেয় নাকি বেশি দেয় তা সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না। তবে তাদের সূক্ষ্ম কারসাজি আছে। আমি বাইকের জন্য একেকবার একেক জায়গা থেকে তেল ভরি। দেখা যায় একই তেলে সমপরিমাণ দূরত্বে পৌঁছানো যায় না। তারা যে তেলের মাপে আমাদের ঠকায় তা আমরা বুঝতে পারি না। কখনো সন্দেহ হলে বলতেও পারি না। উল্টো-উটকো ঝামেলা পড়তে হয়। তারা যেভাবে দেয় আমরা সেভাবেই নিয়ে যাই।
আইন অনুযায়ী, এক লিটার তেলে তিন মিলিলিটার কম দিলেই জরিমানার বিধান রয়েছে। ওজনে তেল কম দিলে অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা জরিমানা আবার প্রতিটি অপরাধের জন্য অর্থদণ্ডসহ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে দণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে গাড়ির মালিকদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন। আইন থাকলেও আইনের বালাই নেই। মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় এমন কারসাজি ধরা পড়লে নামমাত্র শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সমাধান হয় না।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিভিন্ন পাম্পে প্রতি এক লিটার তেলে ১১০ মিলি লিটার কম দেওয়া হয়। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার লিটার তেল বিক্রি হয় একটি পাম্পে। দিনে চুরি ১৬৫ লিটার তেল। সে হিসেবে প্রতিদিন ক্রেতাদের ঠকানো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার টাকা। যা মাসে ৬ লাখ টাকায় ঠেকে।
আইন অনুযায়ী, এক লিটার তেলে তিন মিলিলিটার কম দিলেই জরিমানার বিধান রয়েছে। ওজনে তেল কম দিলে অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা জরিমানা আবার প্রতিটি অপরাধের জন্য অর্থদণ্ডসহ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে দণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে গাড়ির মালিকদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন। আইন থাকলেও আইনের বালাই নেই। মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় এমন কারসাজি ধরা পড়লে নামমাত্র শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সমাধান হয় না।
>> আরও পড়তে পারেন
করিব হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, মাস খানেক আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি পেট্রোল পাম্প থেকে মোটরবাইকে তেল ভরি। সাড়ে ৭ লিটার তেলের ট্যাঙ্কিতে ওরা ১২ লিটার তেল ভরেছে বলে দাবি করে তারা। সেই সময় পেট্রোল পাম্পের লোকজনের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করেও কোনো লাভ হয়নি। বরং ১২ লিটারের দাম আমাকে পরিশোধ করতে হয়েছে।

বিএসটিআই জানিয়েছে, বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে মাপে কম দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ ডিফেন্ডিং ইউনিটের মাধ্যমেই তেল বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে যানবাহনের মালিকেরা মাপে ঠকছেন। বিভিন্ন পাম্পে অভিযান চালিয়ে বিএসটিআই কারসাজির সত্যতাও পেয়েছে।
নাসরুল্লাহ নামের এক ভুক্তভোগী জানান, আমি গাড়িতে ১২ লিটার তেল ভরানোর জন্য পাম্পে গিয়েছিলাম, কিন্তু ট্যাঙ্কে মাত্র ১০ লিটার ঢোকানো হলো। পাম্প কর্মকর্তা কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
অপর এক ভুক্তভোগী রাশেদ আলম বলেন, কিছু পাম্পে মেশিন ঠিকভাবে কাজ করছে না। কখনও ভেজাল তেলও দেওয়া হয়। আমরা জানি না, কার কাছে অভিযোগ করব।
গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশি কিছু ফিলিং স্টেশন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়। যাত্রাবাড়ীর আসমা ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার সাজেদুর বলেন, আমাদের অটো মেশিনের কাউন্ট করা হয়। এতে হিসেবে কম যায় নাকি বেশি যায় সেটা আমরা দেখি না। মেশিনের ভুল হলে সেটা আমাদের করার কিছু থাকে না।
আরও পড়তে পারেন:
জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ৫৮৪ কোটি টাকার এলএনজি কিনবে সরকার
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, জনগণকে তারা যে তেল সরবরাহ করছে তার সঠিক কিনা তা তদারকির দরকার। মেশিনের ত্রুটি থাকলে ঠিক করতে হবে। মেশিনের ত্রুটির দোহাই দিয়ে ঠকানোর কোনো মানে হয় না। মেশিন ঠিক আছে কিনা তা মালিককে দেখতে হবে। অন্যথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট দফতর তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
পেট্রোল পাম্পে যেসব পরিমাপক রয়েছে, এর মধ্যে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় কিছু মেশিন পাওয়া যায়। অন্যদিকে আমেরিকা থেকে প্রতিটি ১০ লাখ টাকায় যেসব মেশিন আমদানি করা হয়, সেগুলো টেম্পারিং করা যায় না। আবার দামি এই মেশিন ব্যবহারে পেট্রোল পাম্প মালিকদের বাধ্যও করতে পারে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। কারণ, দুই ধরনের মেশিন একই কাজ করে।
জ্বালানি বিভাগের পুরোনো এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৭৭টি পেট্রোল পাম্পে অভিযান পরিচালনা করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এর মধ্যে ৪৫টি পেট্রোল পাম্পেই পরিমাপে গরমিল পাওয়া গেছে। সেই হিসাব বলছে, দেশের ৫৮ ভাগ পেট্রোল পাম্পই পরিমাণে কম দেয়।

জানা গেছে, পেট্রোল পাম্পে যেসব পরিমাপক রয়েছে, এর মধ্যে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় কিছু মেশিন পাওয়া যায়। অন্যদিকে আমেরিকা থেকে প্রতিটি ১০ লাখ টাকায় যেসব মেশিন আমদানি করা হয়, সেগুলো টেম্পারিং করা যায় না। আবার দামি এই মেশিন ব্যবহারে পেট্রোল পাম্প মালিকদের বাধ্যও করতে পারে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। কারণ, দুই ধরনের মেশিন একই কাজ করে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পাম্প পরিদর্শন করে থাকে। যেখানে অনিয়ম পাওয়া যায়, সেখানে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে আরও স্বচ্ছতা ও তত্ত্বাবধায়ন বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।
>> আরও পড়তে পারেন
ভোক্তা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, মহাসড়কের পাশ থাকা পাম্পগুলো বেশি কারচুপি করে থাকে। আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। অপরাধীদের শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। আসলে মালিকদের সততা না থাকলে কোনো আইনেই তাদের ফেলা কঠিন। তারা ফাঁকিবাজি করবেই।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাপে কম দেওয়া এটা একটি গুরুতর অপরাধ। সরকারের এ বিষয়ে তদারকি আরও জোরদার করা দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অপরাধ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তবে এক্ষেত্রে সব পক্ষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করতে হবে।
এমআর/এএস