মহিউদ্দিন রাব্বানি
০৮ আগস্ট ২০২৫, ০৬:১৫ পিএম
দেশে চালের বাজারে দীর্ঘ সময় ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মাস দেড়েক ধরে অতিরিক্ত ধরে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপণ্যটি। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও দাম কমার কোনো আলামত আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বরং বাড়ছে দামের পারদ। যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যটি কিনতে হিমশিম খাচ্ছে ক্রেতারা। ফলে দামের কথা চিন্তা করে মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে চলছে ভোক্তারা।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে মোটা চালের দামই ৬০ টাকার বেশি। আগে যে চাল নিম্ন আয়ের মানুষের প্রধান ভরসা ছিল, সেটিও এখন অনেকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
মাঝারি মানের কিছু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল পাওয়া যাচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে, তবে এ দামও এক বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি। বাজারে অন্য সব চাল সাধারণত ৭৫ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর ভালোমানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাল ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দামের ঊর্ধ্বগতির কারণ
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি কারণে চালের দাম দীর্ঘ সময় ধরে চড়া রয়েছে। এর অন্যতম হলো উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ধানের বাজারে পাইকারি দরে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচের চাপ। এছাড়া চাল আটা–মিল মালিকদের মধ্যে অঘোষিত সমন্বয় ও বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ সংকটও দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে স্থায়ী করে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে ধানের দাম এখনো ভালো থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগী ও মিল মালিকদের হাতে যাওয়ার পর দাম দ্বিগুণের কাছাকাছি হয়ে যায়। ফলে খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। ভোক্তারা অভিযোগ করছেন, সরকারি সংস্থার বাজার তদারকি কার্যক্রম দুর্বল হওয়ায় এই পরিস্থিতি অব্যাহত আছে।
টিসিবির তথ্যমতে, এক বছর আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭৮ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। পাইজাম চাল এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। ইরি চাল এক বছর আগে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।
নিম্নমানের চালে ঝুঁকছে ক্রেতারা!
চালের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির ফলে ক্রেতারা মানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন। উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই পছন্দের ব্র্যান্ড বা চাল না কিনে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের চালের দিকে ঝুঁকছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, যারা আগে ব্র্যান্ডেড বা উন্নত মানের চাল কিনতেন, তারা এখন কম দামের বিকল্প বেছে নিচ্ছেন। এতে স্বাদের পাশাপাশি রান্নার গুণগত মানেও পার্থক্য দেখা দিচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ বাড়তি দাম তাদের মাসিক বাজেটে চাপ সৃষ্টি করছে।
আরও পড়ুন
বৃষ্টির প্রভাবে চাঙা সবজির বাজার, পেঁয়াজে উল্লম্ফন
'ইলিশ দেখতেই ভালো লাগে, দাম শুনে আর কিনতে মন চায় না'
সাদ্দাম হোসেন নামের একজন বলেন, আগে ৬০ টাকা দরে নাজিরশাইল পাওয়া যেতো। এখন সেই দামে পাওয়া যায় মোটা চাল। যা বিআর-২৮ পরিচিত। এতে দামের স্বার্থে আমাদের মানের কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি এবং মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব হবে। অন্যথায়, চালের মানে এই ‘কম্প্রোমাইজ’ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে ক্রেতারা
রাজধানীর শনিরআখড়া মনির এন্টারপ্রাইজে চাল কিনতে আসেন পলাশ সাহা। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগে মোটা চাল ৪৫-৪৮ টাকায় কিনতাম, এখন সেটা ৬০ টাকার ওপরে। সবকিছুর দামই বাড়ছে, কিন্তু আয় তো আগের মতো নেই।’
একইভাবে ডেমরা এলাকার গৃহিণী সুমি আক্তার বলেন, ‘চাল কিনলেই মাসের বাজেট ফুরিয়ে যায়। এখন মানের দিক থেকে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি, তবু খরচ সামাল দিতে পারছি না।’
বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে দাম না কমায় খুচরা বাজারে মূল্য স্থিতিশীল হচ্ছে না। তারা আরও জানান, ক্রেতারা এখন মানের চেয়ে দামের দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন, ফলে উন্নত মানের চালের বিক্রি কমে যাচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগ ও বিশেষজ্ঞ মত
সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে টিসিবি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে সরবরাহ চেইনে অসঙ্গতি ও বাজারে এক ধরনের অঘোষিত কারসাজির কারণে সেই পদক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানির পথে শুল্ক হ্রাস, মজুতব্যবস্থার কড়া নজরদারি এবং কৃষকের হাতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করলে বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কৃষকরা যদি ভালো দামের আশায় ফসল কাটার মৌসুমে ধান মজুত করে রাখেন এটাতে ইতিবাচক দিক রয়েছে। এটি বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো। কারণ ধান বা চালের ঘাটতি বা সংকট দেখা দিলে কৃষকরা তাদের মজুতকৃত ধান সরবরাহ করতে পারেন।’
আরও পড়ুন
বাজারে কারসাজি, কোথাও নির্ধারিত দামে মিলছে না এলপিজি
ওঠানামা করছে বাজার দর, বিরূপ প্রভাব জনজীবনে
চালের বাজার দর প্রসঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মিলারদের কাছে কিন্তু পর্যাপ্ত চাল আছে। কৃষকরা কম দামে ছাড়লেও মিল গেইটে এলে দাম বেড়ে যায়।’
তার মতে- ‘বাজার তদারকির বিষয়ে কিছু গ্যাপ রয়েছে। সমন্বয়হীনতা রয়েছে। খুচরা বাজারে অভিযান চালালেও মিল-কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয় না। চালের বাজারে অস্থিরতা দূর না হলে ভোক্তাদের ওপর চাপ আরও বাড়বে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।’
এমআর/জেবি