শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ওঠানামা করছে বাজার দর, বিরূপ প্রভাব জনজীবনে

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৬ এএম

শেয়ার করুন:

ওঠানামা করছে বাজার দর, বিরূপ প্রভাব জনজীবনে
  • বাজারে অস্থিরতার ঢেউ, বাড়ছে অস্বস্তি
  • দু-একটি পণ্য ছাড়া বাড়ছে সব পণ্যের দাম
  • বাজার নজরদারির অভাবে ইচ্ছেমতো দাম হাঁকছে ব্যবসায়ীরা
  • গোপন সমন্বয় চুক্তির মাধ্যমে পণ্যের ঘাটতি দেখানো হচ্ছে
  • সংসারে নানা রকম কাটছাঁট করতে হচ্ছে গ্রাহকদের

নিত্যপণ্যের বাজারে দামের ওঠানামা এখন নিয়মিত এক বাস্তবতা। আজ কিছুটা কম, কাল আবার বেড়ে যাচ্ছে—এই দোলাচলে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছেন প্রতিদিনকার বাজারে গিয়ে।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে—শাক-সবজি, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, সবজি, ডিম, মুরগি ও মাছের দাম প্রায় প্রতিদিনই পরিবর্তিত হচ্ছে। বাজারে কোনো নির্দিষ্ট দামের নিশ্চয়তা নেই। এক দোকানে একটি দামে, অন্য দোকানে তার চেয়ে বেশি।

সবজির বাজারে এমন পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে যেসব সবজি ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া গেছে, সেগুলোর দাম এক লাফে বেড়ে ৭০-৮০ টাকায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে ডিমের দাম কয়েকদিন কম থাকলেও আবার বাড়তির দিকে। ব্রয়লার মুরগির দামও স্থিতিশীল না থেকে প্রায়শই ওঠানামা করছে।

এমন অবস্থায় বাজারে কেন এই অস্থিরতা—জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকেই দামে ভিন্নতা আসছে। অনেক সময় পণ্য আসা কমে যায়, আবার কোনো কোনো সময়ে পরিবহন সমস্যার কারণে সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া প্রকৃতির দুর্যোগেও বাজার দরে প্রভাব ফেলে। যার ফলে প্রতিদিনই দামের ব্যবধান তৈরি হয়।


বিজ্ঞাপন


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের সরবরাহ চেইনে অসঙ্গতি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার এবং স্থানীয়ভাবে গঠিত বাজার সিন্ডিকেট—এসবই এই অস্থিরতার মূল কারণ। তারা আরও বলছেন, বাজারে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করছে।

ভোক্তাদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে অসহায়ত্বের চিত্র

রামপুরার বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, মাসের শুরুতে বাজার করতে গিয়ে দেখি আগের বাজেট মিলছে না। যে পণ্যগুলো কিনতাম, সেগুলো অর্ধেকও কেনা যাচ্ছে না এখন।

পরিবহন শ্রমিক লিয়াকত আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, নিত্য পণ্যের দাম বাড়লেও আয় বাড়ছে না। সব সামাল দিতে গিয়ে সংসারে নানা রকম কাটছাঁট করতে হচ্ছে।

যাত্রাবাড়ীতে মদীনা সুপার শপের সেলসম্যান ইয়ামিন আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, অভিযোগ রয়েছে বাজারে ব্যবসায়ীরা দাম বেশি রাখে। তবে কথা হচ্ছে আমরাও তো বেশি দামে কিনে আনছি, কম দামে বিক্রি করলে লোকসানে পড়ি। পাইকারি বাজারেই তো দাম ঠিক থাকে না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ আরও জোরালো হওয়া উচিত। নিয়মিত বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, মূল্য তালিকা নিশ্চিতকরণ এবং সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন টিম কাজ করছে এবং যেখানে সমস্যা ধরা পড়ছে, সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবে ভোক্তারা এর সুফল খুব একটা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

দাম ওঠানামার বিষয়ে ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা কারণ হিসেবে বলছে, সরবরাহ চেইন সমস্যা, পরিবহন সংকট ও জ্বালানি তেলের খরচ, বাজার সিন্ডিকেট ও কারসাজি।

সরবরাহ চেইনে সমস্যা

বাংলাদেশে কৃষিপণ্য এখনো পুরোপুরি সংরক্ষণ-নির্ভর নয়। ফলে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মৌসুমভিত্তিক ঘাটতি বা পরিবহন সংকটে সহজেই সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অস্থিরতার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা কৃষক থেকে স্বল্প দামে পণ্য কিনে শহরের বাজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করেন।

ডলারের দাম ও আমদানি নির্ভরতা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের উচ্চ বিনিময় হারও বড় প্রভাবক। কারণ ডাল, ভোজ্যতেল, মসলা ও কিছু ফল আমদানিনির্ভর। ডলারের দাম বাড়লে এসব পণ্যের দামও বাড়ে।

সিন্ডিকেট ও কারসাজি

ব্যবসায়ীদের গোপন সমন্বয় কিংবা অঘোষিত চুক্তির মাধ্যমে পণ্যের ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা খুব কমই নেওয়া হয়। এমনকি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানও অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের নীতিগত দুর্বলতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব বাজার ব্যবস্থাকে আরও অনিয়ন্ত্রিত করে তুলেছে। শুধু তাৎক্ষণিক অভিযান নয়, প্রয়োজন পণ্যের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পুরো ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও স্বচ্ছ করা।

বাজারে নিত্যপণ্যের দামের যে অস্থিরতা চলছে তা শুধু একটি শ্রেণিকে নয়, পুরো সমাজ ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করছে। এটি শুধু ভোক্তার জন্য নয়, সরকারের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাজারে এই লাগামহীন দামের অস্থিরতা না থামলে জনজীবনে চাপ আরও বাড়বে। পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনা, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় ও ভোক্তা স্বার্থে কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা জাতীয় সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। ব্রয়লার বা ডিমের দাম কিছুটা কম কমলেও বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম বাড়তি। এতে বেশি প্রভাব পড়ে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। এছাড়া যাদের আয়-উপার্জন নির্দিষ্ট পরিমাণের তারাও বিপদের মুখোমুখি হয়ে যান।

এর প্রভাব রয়েছে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও। কারণ অল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেররা পরিবারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায়। ফলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। কলহের জেরে টানাপোড়েনে পড়ে সংসার জীবন।

এছাড়াও পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে অনেককেই খরচে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেনাকাটা করতে হয় তাদের।

এমআর/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর