images

অর্থনীতি

চামড়ার দামে ভেল্কি, সরকারের দর শুধু কাগজে!

মহিউদ্দিন রাব্বানি

১১ জুন ২০২৫, ০৯:৩৭ এএম

চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে। তবে বরাবরই অবহেলিত এই শিল্পটি। এবার ঈদের আগে সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কোথাও বিক্রি হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার ঘোষিত দর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার জন্য সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা এবং খাসির জন্য ২০ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে এর অর্ধেক দামেও চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ স্থানে সংগ্রহকারীরা সরকার নির্ধারিত মূল্যের দিকে লক্ষ্য না রেখে মনগড়া দামে চামড়া কিনেছেন। কোথাও কোথাও প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ২০-২৫ টাকা, আবার কোথাও ১০-১৫ টাকায় কেনা হয়েছে। অনেক জায়গায় বিক্রি তো দূরের কথা, চামড়া সংগ্রহ না হওয়ায় মানুষ তা রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছে বা মাটিতে পুঁতে ফেলেছে।

আরও পড়ুন

এবারও কাটেনি কোরবানির চামড়া নিয়ে হতাশা

অথচ ঈদুল আজহার আগে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে সরকার জানায়, এবার চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গত বছরের তুলনায় পাঁচ টাকা বাড়ানোও হয়। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

এবিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম এক হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

lathar_20250607_215402394

উপদেষ্টার এমন ঘোষণার পরেও বাজারে চামড়ার দামে দেখা গেছে ভেল্কিবাজি। দাম নির্ধারণ কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল। বঞ্চিত হয়েছে চামড়ার হকদাররা। হতাশা ও বঞ্চনায় ব্যবসায়ীরা।

কুমিল্লার এক কোরবানিদাতা বলেন, সরকারি রেটে (দাম) চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। প্রতি বর্গফুট মাত্র ১৫ টাকা দামে বিক্রি করেছি। সরকার বলেছিল ৫০ টাকার ওপরে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখিনি।

কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ী সুমন মিয়া ৬০টি লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে পোস্তায় আসেন। তিনি শুধু ঈদের মৌসুমে চামড়ার ব্যবসা করে থাকেন। ছোট-বড় মিলিয়ে ৬০টির মতো চামড়া কিনেন ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা দরে। তারপর লবণ দেন। সেই চামড়া পোস্তায় ৫০০ টাকা দাম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। এতে হতাশ সুমন মিয়া। 

এদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা সম্ভব নয়। কারণ ফিক্সড প্রাইসের সঙ্গে বাস্তব বাজার পরিস্থিতির বিস্তর ফারাক রয়েছে। তারা দাবি করেছেন, লবণ, পরিবহন এবং সংরক্ষণের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ঘোষিত দাম বাস্তবসম্মত নয়।

আরও পড়ুন

ফেসবুকে ও কিছু মিডিয়ায় চামড়া নিয়ে অপপ্রচার চলছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

অন্যদিকে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া মাঠপর্যায়ে মনিটরিং যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ায় দামের ভারসাম্য রাখা যাচ্ছে না। তারা জানান, লোকবল ও সক্ষমতার ঘাটতির কারণে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি।

চামড়া শিল্পের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতি বছর একই ধরনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অথচ কার্যকর কোনো সমাধান আসছে না। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও বিকল্প মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে।

দেশের অন্যতম রফতানিমুখী শিল্প খাত হিসেবে চামড়ার গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে ভবিষ্যতে কোরবানির মৌসুমে আরও বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে নির্ধারিত দামে বেচাকেনা হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথ মনিটরিং না থাকলে সরকারি নির্দেশনা কার্যকর হয় না। প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন। অনেক ব্যবসায়ী দাম না পেয়ে কম মূল্যে বা বাকি দিয়ে চামড়া বিক্রি করেন।

Lather3

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ হয় কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। 

চামড়ার কারসাজিতে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন। চামড়া শিল্পে কাঁচামালের সরবরাহ ও মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার হার বাড়ে, ফলে দেশীয় শিল্প এবং রফতানি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি কোরবানির চামড়ার যে হকদার গরিব-দুঃখী মানুষ, তারা বেশি বঞ্চিত হন।

আরও পড়ুন

অপ্রীতিকর ঘটনামুক্ত এবারের ঈদ, স্বস্তি রাজধানীবাসীর

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি মনিটরিং ও প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সমন্বয় জরুরি। চামড়া সংরক্ষণের জন্য অস্থায়ী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। চামড়া সংগ্রহে ডিজিটাল পেমেন্ট বা সরাসরি কৃষক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেতে পারে।

চামড়ার দাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এ বছর ছোট গরুর চামড়া বেশি। তবে সার্বিকভাবে চামড়ার সরবরাহ ভালো। গত বছরের তুলনায় প্রতিটি চামড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দাম রয়েছে।

এমআর/জেবি