বোরহান উদ্দিন
০৪ মার্চ ২০২৫, ১০:০৪ এএম
প্রথম রোজার দিন স্ত্রীকে নিয়ে বাইতুল মোকাররম এলাকায় কেনাকাটা সেরে ফুটপাতের খেজুরের ভ্যানে ঢুঁ মারেন ওয়ারীর বাসিন্দা জুলফিকার আলী। হাজার টাকার মধ্যে পছন্দসই খেজুর কিনবেন এমন চিন্তা থাকলেও দাম শুনে কিছুটা আশ্চর্য হন এই দম্পতি। কারণ ভ্যানে সাজানো পছন্দের মেডজুল খেজুরের দিকে ইশারায় করতেই বিক্রেতা জানালেন এক কেজির দাম ১৮০০ টাকা। পরে বেশ কিছু সময় দরদাম করে ১৫০০ টাকায় এক কেজি খেজুর নিয়ে বাসায় ফেরেন তারা।
বিক্রেতা জানালেন, মেডজুল নামেই কয়েক ধরনের খেজুর আছে। আকারে ছোটগুলো ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু বড় আকারের ফ্রেশ মেডজুল কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই।
এই বিক্রেতার দোকানে দেখা গেছে আট প্রজাতির খেজুর রয়েছে। জানালেন, ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮০০ টাকা কেজির খেজুর আছে তার কাছে। তবে একটু পছন্দের খেজুর কিনতে চাইলে তাদের ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা গুনতে হবে। কারণ দামের দিক থেকে এর নীচে গেলে যুতসই খেজুর মিলবে না।
ঢাকা মেইলকে পুরানা পল্টনের এই খেজুরের ক্রেতা জুলফিকার আলী বলেন, ‘চিন্তা করেছিলাম ১ হাজার টাকা কেজিতে খেজুর পাব। কিন্তু এসে দেখলাম বাজেট বাড়াতে হয়েছে। শুনছিলাম খেজুরের দাম এবার কমবে। বাস্তবে তা তো মনে হলো না।’
যদিও বিক্রেতা পাশ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘রোজার আগে খেজুরের দাম নিয়ে আগে যেমন হুলস্থুল পড়ত এবার এমনটা হয় নাই। দাম আগের মতোই আছে। একদম কম দামি খেজুরও আছে। কিন্তু সবাই তো কিনবে না। আর খেজুর আমদানিতে ডিউটি ফ্রি করলে কী হবে; ডলারের দাম তো অনেক বেশি। ডলারের দাম কম থাকলে আরও কম দামে বিক্রি করা যেত।’
শুধু পল্টন নয়, সেগুনবাগিচা, গুলিস্তান, শান্তিনগর বাজার, রায়সাহেব বাজার, লক্ষ্মীবাজার, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সদরঘাটের একাধিক খেজুরসহ অন্যান্য বিদেশি ফলের দোকানে ঘুরে দেখা গেছে, নানা প্রকারের খেজুর থাকলেও একটু ভালো মানের পণ্য হাজারের নিচে মিলছে না। অবশ্য দরদাম করলে কখনো কখনো ৭০০ থেকে ৮০০ টাকাতেও হাজার টাকা দামের খেজুর কেনা যাচ্ছে।
অবশ্য দাম যাই হোক, এরমধ্যেও রোজাদাররা ইফতারির জন্য দেদারসে কিনছেন খেজুর। বিশেষ করে পল্টনের একাধিক দোকানে দেখা গেছে তাদের যেন দম ফেলার সুযোগ নেই। দোকানিরা জানিয়েছেন, বিকেলে অফিস ছুটির পর আর তারাবির নামাজের পর ক্রেতার চাপ বেশি থাকে।
কিছু কিছু দোকানে দেখা গেছে, প্যাকেটজাত করে খেজুর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্যাকেটের গায়ে খেজুরের কেজি প্রতি দামও লিখে রাখা হয়েছে। যাতে ক্রেতারা সহজে দাম দেখে কিনে নিতে পারেন।
রায়সাহেব বাজারের ফল বিক্রেতা বেলায়েত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গায়ে দাম লিখে রাখলে কম কথা বলতে হয়। না হলে ধরে ধরে সবগুলোর দাম জেনে পরে এক ধরনের খেজুর নেয় লোকজন।’
বিক্রি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য বছরের তুলনায় খেজুরের দাম তুলনামূলক ভালো আছে। অনেক বেশি আবার অনেক কম তা বলা যাবে না। মানুষ বাজেট অনুযায়ী কিনতে পারছে।’
কোন খেজুরের কেমন দাম
একাধিক খেজুর বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানভেদে সর্বনিম্ন ২০০ টাকায় কিছু খেজুর বিক্রি হচ্ছে। বাংলা নামের এই খেজুর মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি কিনছেন। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে ভ্যানে, ফুটপাতেও মিলছে এসব খেজুর।
মেডজুল খেজুর ১২০০- ১৮০০ টাকা, আজোয়া খেজুর ৯০০-১৩০০ টাকা, কামরাঙা মরিয়ম খেজুর ৭০০-১৪০০ টাকা, সুকারি খেজুর ১০০০ টাকা, আম্বার খেজুর ১৬০০ টাকা, কলমি মরিয়ম ৭০০-১০০০ টাকা, তিউনেশিয়ার খেজুর ৪৫০ টাকা, কাঁচা খেজুর ৬০০ টাকা, মাখরুম খেজুর ৮০০-১৫০০ টাকা, সুগাই জাতের খেজুর ৯৫০ টাকা, ছড়া খেজুর ৬০০ টাকা, দাবাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৬০- ৫০০ টাকা, জাহিদি ২০০- ৩০০ টাকা এবং বরই খেজুর ৪৫০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে পবিত্র রমজান সামনে রেখে গত নভেম্বরে খেজুরের আমদানি শুল্ক কমায় সরকার। বিভিন্ন ধরনের খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ২৫ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সেই সঙ্গে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত অগ্রিম কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়। খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে এই সুবিধা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
যে কারণে ধারণা করা হয়েছিল এবছর অন্যবারের তুলনায় খেজুরের দাম কম হবে। তবে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি বলে মনে করেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। দাম বৃদ্ধির জন্য এই খাতের সিন্ডিকেটের পাশাপাশি আমদানিকারকদের ‘মিথ্যা ঘোষণা’ দিয়ে পণ্য আমদানিকেও দুষছেন কেউ কেউ।
খেজুরের বাজার বাড়ে রমজানে
সারাবছর ধরে ফলের দোকানে খেজুর বিক্রি হলেও রমজানের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। যে কারণে ১১ মাসের তুলনায় এক মাসেই বছরের চাহিদার অর্ধেকের বেশি খেজুর প্রয়োজন হয়। তাই আগেভাগেই আমদানিকারকরা খেজুর সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন।
ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে আসা খেজুরগুলো মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, জর্দান, ইরাক, ইরান ও পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ইরাকি জায়েদি খেজুরের।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে খেজুরের চাহিদা থাকে ৪০ থেকে ৫৫ হাজার টন।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে খেজুর আমদানির তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের গত সাড়ে ৭ মাসে ৩৭ হাজার ৫৭০ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। যার প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি হয়েছে গত দেড় মাসে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৪৯ টন। আর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ দিনে আমদানি হয়েছে ১৬ হাজার ৭৯৪ টন। আরও খেজুর পথে আছে বলে জানা গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খেজুর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে প্রবেশ করে দেশের বাজারে। অন্য কিছু খেজুর আসে বিমানে।
অন্যান্য খাতের মতো খেজুরের বাজার স্থিতিশীল রাখতে মনিটরিং জোরদারের দাবি জানিয়েছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমদানি করা পণ্যে ব্যবসায়ীরা শুল্ক দেওয়ার সময় কম মূল্য ঘোষণা করেন। আর এই জিনিসই যখন তারা বিক্রি করেন তখন বাড়তি দাম দেখান। এজন্য এনবিআরের উচিত কোন গ্রেডের খেজুরের দাম কত সে তথ্য প্রকাশ করা। পাশাপাশি সে অনুযায়ী বাজারে দাম ঠিক আছে কি না তাও মনিটরিং করতে হবে। তাহলেই কেবল সুফল মিলতে পারে।’
বিইউ/ইএ