কাজী রফিক
১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:০৮ পিএম
প্রতিদিনের জীবনে ভোক্তা ঠকে যাচ্ছেন পদে পদে। পণ্য কিনতে গিয়ে সতর্ক থাকার পরেও ঠকতে হচ্ছে। কখনও টাকা বাঁচাতে গিয়েও ঠকছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণা যেমন বাড়ছে, নজরদারি না থাকায় বাড়ছে প্রতারকও৷
রাজধানীতে ভোক্তাকে অভিনব কায়দায় ঠকানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফল ব্যবসায়ীদের একাংশ৷ নগরীর শ্যামলী এলাকার ফলের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সব ধরণের ফল ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয় কাগজের ঠোঙায়। এক কেজি পরিমাণ ফল যে ঠোঙায় দেওয়া হয়, তার ওজন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম।
ফল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি ডালিম তারা বিক্রি করছেন ৪০০ টাকা দরে। ফল পরিমাপের সময় ঠোঙার ওজন বাদ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে ক্রেতাকে ঠোঙা কিনতে হচ্ছে ফলের দামে।
ক্রেতা ঠকানোর এমন অভিনব কৌশল দেখা গেছে রাজধানী লাগোয়া আটি বাজার এলাকায়ও। কম দামে মিষ্টি বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ এ এলাকায় মিষ্টির ওজন পরিমাপের সময় ঠোঙার ওজন বাদ দেওয়া হয় না। ফলে মিষ্টির দামেই কাগজ কিনতে হচ্ছে ক্রেতাকে। যার একেকটি ঠোঙার ওজন এক থেকে দেড়শো গ্রাম।
কারসাজির এসব ঠোঙা পণ্য বিক্রয়কারীরা তৈরি করেন না। এসব ঠোঙা তৈরি হয় আলাদা কারখানায়। রাজধানীতে বসবাসকারী উর্দুভাষীদের একটি অংশ এই ঠোঙা তৈরির কাজ করেন। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, সোহেল বক্স নামে একটি দোকানে তৈরি হচ্ছে এসব ঠোঙা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক থেকে দেড় কেজি পরিমাণ ফল দেওয়া যায়, এমন আকারের ঠোঙার ওজন ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম পর্যন্ত। দুই কেজি পরিমাণ ফল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত ঠোঙার ওজন হয় একশো গ্রামের বেশি। এক কেজি পরিমাণ মিষ্টি ধারণক্ষম ঠোঙার ওজন একশো গ্রামের বেশি। দুই কেজি পরিমাণ মিষ্টি ধারণক্ষম ঠোঙার ওজন প্রায় দুইশো গ্রাম।
নকল পণ্যে সয়লাব বাজার
ভোক্তা ঠকানোর আরেক মাধ্যম হয়ে উঠেছে নকল পণ্য। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মতোই দেখতে নকল অনেক পণ্যই এখন বাজারে৷ বিশেষ করে গোসলের সাবান, কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট এবং নানা প্রসাধনী৷ তবে এমন নকল পণ্য যারা বাজারজাত করেন, তারাও বেশ কৌসুলি।
অনুমোদনহীন এবং নকল গোসলের সাবান, কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট, টয়লেট টিস্যু এসব পণ্য বাজারজাত করার পদ্ধতিও ভিন্ন। নগরীর নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস, এমন এলাকায় বাজারজাত করা হয় এসব পণ্য।
পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার হাতিরঘাটে এসব নকল পণ্য বিক্রির তোড়জোড় দেখা গেছে। ভ্যান গাড়িতে থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। একটু দূর থেকে দেখলেই মনে হবে নামকরা প্রতিষ্ঠানের সব জনপ্রিয় পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এসব পণ্য প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানির নয়। ৫৭০ সাবানের আদলে তৈরি করা হয়েছে ৬৭০ সাবান। হারপিকের আদলে তৈরি করা হারপুন, লাক্স সাবানের আদলে তৈরি করা হয়েছে লিলি।
এমন আরও বেশ কিছু পণ্য বিক্রি হতে দেখা গেছে, গাবতলি, মিরপুর মাজার রোড, নন্দীপাড়া, সদরঘাট এলাকায়।
আমদানি করা পণ্যের নামে ঠকছেন ক্রেতারা
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পণ্যের চাহিদা দেশে বেশ ভালো। যার একটি বড় জায়গা দখল করে আছে প্রসাধনী সামগ্রী। বাংলাদেশে বসবাসকারী নারীরা এসবের বড় ক্রেতা। তবে, ভারতীয় পণ্যের নামে বিক্রি হওয়া নকল পণ্যই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সব ধরণের প্রসাধনী সামগ্রীর ছড়াছড়ি রয়েছে মার্কেটটিতে। ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে ভারতীয় লেকমি ব্রান্ডের কাজল। তবে পণ্যের গায়ে দাম লেখা ১৯০ রুপি। বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে ভারতের ১৯০ রুপি দাঁড়ায় ২৭১ টাকা৷ এরপর আমদানি শুল্ক যোগ হওয়ার কথা। একই চিত্র ফগ বডি স্প্রেতে। ২৫০ রুপি দামের বডি স্প্রে আসল বলে বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এমন সকল ভারতীয় নকল পণ্যই দেশে পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, লেকমির কাজল নকলটা ৪০ টাকায় কেনা। ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ আমাদের আসলটা বিক্রি করতে হয় ৩৫০ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব নকল পণ্যের বেশিরভাগই তৈরি হয় কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা, সাভারের হেমায়েতপুর-আমিনবাজার এলাকায়।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী ঢাকা মেইলকে বলেন, অরজিনিয়াল প্রোডাক্ট যারা বিক্রি করেন, তারা বাকি দেন না। নকল প্রোডাক্ট নিলে আপনি ২০ হাজার টাকা ক্যাশ নিলে ৫০ হাজার টাকার প্রোডাক্ট পাবেন। তাই নকলটার দিকেই আমাদের নজর বেশি থাকে। আর নকল প্রোডাক্টে লাভও বেশি।
ক্রেতাকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ ক্যাবের
এসব বিষয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ভোক্তাকে দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন
ঠোঙার মাধ্যমে ক্রেতাদের ঠকানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ক্রেতাকে সতর্ক হতে হবে। এখানে ভোক্তা অধিকার কিছু করতে পারবে না। যে সকল দোকানদার ঠোঙার ওজন বাদ দেবে না, সে সব দোকান থেকে পণ্য কেনা যাবে না।
নকল পণ্যের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, যেসব পণ্যের আদলে নকল পণ্য তৈরি করা হচ্ছে, এ বিষয়ে তো আপনি সাংবাদিক, আপনি মামলা করতে যাবেন না। আমি বা ক্যাবও মামলা করবে না। এটা মূলত যাদের কোম্পানি, তাদের ট্রেডমার্কের জন্য নিজেদের মামলা করতে হবে৷ কারণ তারা আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে আসল-নকলের পার্থক্য বুঝে ক্রেতাকে পণ্য কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
কারই/এমএইচএম