images

অর্থনীতি

কলমানি সুদহারে সীমা লঙ্ঘন, শাস্তির হুঁশিয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৪ এএম

বিপুল খেলাপি ঋণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচন নীতিসহ নানা কারণে ভয়াবহ তারল্য সংকটে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারল্য সংকটের ধকল সামলাতে তফসিলি ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (এনবিএফআই) নিজেদের মধ্যে কলমানিতে (ওভার নাইট) ধারদেনা করছে। অধিকাংশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সুদের সীমা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ মানার বালাই নেই। সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ রেট পর্যন্ত ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা লেনদেন করেছে ৩৩টি ব্যাংক এবং ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সুদের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রতিষ্ঠানগুলো সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সুবিধাও বাতিল হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

সিএসআর ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ ১০ ব্যাংকের, পাঁচটি শূন্য

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৩টি ব্যাংক বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ৯ টাকা ৫০ পয়সা সুদের সীমা লঙ্ঘন করে ৩ হাজার ১০৫ কোটি ধার করেছে। একই সময়ে ২ হাজার ৬১০ কোটি অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে। এটা ব্যাংকগুলোর জন্য অনেকটা চিরাচরিত নিয়ম বলা যায়। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে বাগড়া দেখা দিয়েছে। একইভাবে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সুদের সীমা ভেঙে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ হারে ৯৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ধার করেছে। এ ধরণের লেনদেন ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থী হিসেবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কলমার্কেটে অন্য ব্যাংক থেকে ৪৮১ কোটি টাকা ধার করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক একই রেটে ৯৫ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। আর বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে ৪৫৯ কোটি টাকা দার দিয়েছে।

আরও পড়ুন

সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে ব্যাংকঋণের সুদহার

বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৩০৪ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। ব্যাংক সিলং ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১১৬ কোটি টাকা, একই রেটে ব্যাংক আল ফালাহ ১৭৬ কোটি টাকা কলমানিতে ধার দিয়েছে।

বেসরকারি সিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৩০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। এবি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা দরে ৬০ কোটি টাকা ধার করেছে। মিডল্যান্ড ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদহারে ২৩৫ কোটি ধার করেছে।

এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা হারে ২০৯ কোটি এবং সিটিজেন ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা হারে ১৮ কোটি টাকা অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে। ইউসিবি ৯ টাকা ৭৫ পয়সা হারে ২৯৭ কোটি ধার করলেও ব্যাংকটি ৯ টাকা ৮০ পয়সা রেটে ২৮০ কোটি টাকা অন্য ব্যাংকে ধার দিয়েছে।

এনসিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ১০৪ কোটি, এনআবি একই দরে ৭৫ কোটি ধার করেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কলমানি হচ্ছে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের টাকা ধার নেওয়ার একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৈনন্দিন ও স্বল্প মেয়াদে টাকার চাহিদা মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত তারল্য থাকে, তারাই মূলত ধার দিয়ে এর বিনিময়ে সুদ নেয়। সুদের হার নির্ভর করে কত দিনের জন্য টাকা ধার নেওয়া হচ্ছে তার ওপর। আবার কখনো কখনো চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করেও সুদহার ওঠানামা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে কলমানি দেওয়া হয়।’
এদিকে ইস্টার্ন ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা দরে ১২৩ কোটি টাকা, এসবিএসি ব্যাংক একইদরে ১৪৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা সুদে ৩৬৪ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক  ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৪৫ কোটি টাকা ধার করেছে।

এনআরবিসি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ২৫ কোটি ধার দিয়েছে। মধুমতি ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ১১৫ টাকা ধার করলেও একই রেটে আবার ৬১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দুর্বল: সাবেক গভর্নর

সাউথইস্ট ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা সুদে ৬১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক এশিয়া ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ৮১ কোটি ধার করলেও একই রেটে ৪০ কোটি ধার দিয়েছে।

সীমান্ত ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা রেটে ৬৩ কোটি এবং উত্তরা ব্যাংক ৯ টাকা ৭৫ পয়সা রেটে ৪৬৪ কোটি টাকা বিক্রি করেছে। তবে ওয়ান ব্যাংক ৯ টাকা ৬০ পয়সা রেটে ১০ কোটি, পূবালী ব্যাংক একই রেটে ২৫৫ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে ৪৬৬ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ৯ টাকা ৮০ পয়সা রেটে ৮৫ কোটি এবং কমিউনিটি ব্যাংক ৯ টাকা ৯০ পয়সা সুদে ১০৪ কোটি টাকা ধার করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘তারল্য ব্যবস্থাপনা তো ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়। তবে আইন নীতিমালা মানতে তো বাধ্য। সবাই যদি কলমানি থেকে ইচ্ছেমতো রেটে লেনদেন করে তাহলে তো রেট নির্ধারণের দরকার ছিল না। বাজার লাগামছাড়া হবে। শাস্তির আগে তদন্ত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাদের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘন প্রমাণিত হবে তারাই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে।’

আরও পড়ুন

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৭১০ কোটি

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ কলমানির সুদের হার ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হিসাবে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশের রেকর্ড উঠেছে। ২০১২ সালের পর এটিই কলমানির সর্বোচ্চ সুদহার। ওই বছর কলমানির সুদের ১২ দশমিক ৮২ শতাংশে উঠেছিল সুদহার।

অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইডিএলসি, ডিবিএইচ, পিএফআইএন, বে লিসিং, বিডি ফাইন্যান্স ও আইসিবি নিয়ম লঙ্ঘনের মাধ্যমে কলমার্কেটে লেনদেন করায় শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

টিএই/এমআর