রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দুর্বল: সাবেক গভর্নর

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৪, ০৩:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দুর্বল: সাবেক গভর্নর
সালেহ উদ্দিন আহমেদ। (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন,  বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নীতিগত দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্ট্রংলি বলতে পারে যে, আমরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক অনুমোদন দেব না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে উপরের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকলে হবে না। অর্থনীতির স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হয়। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।

শনিবার (৩০ মার্চ) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির অয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ’ বিষয়ক এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।


বিজ্ঞাপন


রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এত ব্যাংক দিলেন কেন এমন প্রশ্ন রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যেসব ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল তার কোনোটাই ভালো করছে না। এসব ব্যাংকের উদ্দেশ্য‌ই ছিল ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করা। পদ্মা ব্যাংকের মতো এগুলোকে নাম বদলে ভালো করার চেষ্টা না করে লিকুইডেট করে দেওয়াটা সবচেয়ে ভালো।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক আগেই বলেছিলাম এত ব্যাংকের অনুমোদন দিলে মার্জারের সিদ্ধান্তে যেতে হবে। দেরিতে হলেও মার্জার অ্যাকুইজেশনের সিদ্ধান্তটা ভালো। তবে মার্জারের মাধ্যমে ব্যাংক লুটেরা বা দুর্নীতিবাজরা যাতে পার না পেয়ে যায় সে বিষয়ে খুব গুরুত্বসহকারে নজর রাখতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রলেপ দিয়ে ব্যাংক খাতের চিকিৎসা করা যাবে না। অর্থনীতির স্বার্থে এটাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমাদের দেশে মার্জারের ভালো উদাহরণও রয়েছে। যেমন ইস্টার্ন ব্যাংক এখন একটি সবল ব্যাংক। তবে খেয়াল রাখতে হবে ভালো ব্যাংক যেন দুর্বলের প্রভাবে নড়বড়ে হয়ে না যায়। পাশাপাশি দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতকারী গ্রাহকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমি জানি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট বছরে পর বছর ধরে পড়ে থাকে। কিন্তু কোনো অ্যাকশন হয় না। অন্যদিকে পরিচালকরা তাদের ঋণ ভাগাভাগি করতে থাকে। এগুলো একটি অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ। এজন্য ব্যাংকের আইনে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যথা যে আইন আছে সেটার যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

কোন ব্যাংকের কী অবস্থা বোঝার মাপকাঠি কী?

ডলারের অস্থিরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই যে ফরেন এক্সচেঞ্জের অস্থিরতা, আমার সময় ৭৯, ৮০, ৮২ ছিল। কেন বারে বারে বিক্রি করে করে ৮৫, ৮৬, ৮৫ ধাম করে ১০৭ এ চলে গেল। এই যে ক্রলিং পেগ এসবের তো দরকার ছিল না। এসব হয়েছে ডলার বিক্রি করে করে। ১২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি হয়েছে। রিজার্ভের টাকা বিক্রি করে কেন স্টাবল করা হবে। বাইরে দেখাবেন আমার টাকা খুব স্ট্রং। ওরা কি জানে না আপনার টাকা যে উইক। আমরা দুই বছর আগে থেকে বলছি এটা অসুবিধা হচ্ছে। আজকে ভুলের কারণে ব্যাংক থেকে নেওয়ার লাগছে। সোয়াপ-টোয়াপ করে কী হবে? এসব তো সাময়িক।

সালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে এখনো পরিপক্ক হতে পারিনি। বর্তমানে এমন অবস্থা, যিনি রাজনীতি করেন, আবার ব্যবসা করেন, আবার মিডিয়া হাউজের মালিক, তিনি আবার বলেন আমি জনগণের পক্ষে। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যখন সবগুলো একসাথে চালাবে তখন মনের ভেতর একটা জিনিস থাকবে। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, দেশের উন্নয়ন নিয়ে আমরা গর্ব করলেও আর্থিক খাতের অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ হয়। মাথা হেইট হয়ে আসে। ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে সংস্কৃতি আমাদের জন্য একটা বড় কালো দাগ। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ভয়াবহ ক্যানসারের রূপ নিচ্ছে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ, রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি, ফারমার্স ব্যাংকের পতন, পিপলস লিজিং এর অবসায়ন, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনির জালিয়াতি, পুঁজি বাজারের কারসাজি, শেয়ার মার্কেট লুট ইত্যাদি কলঙ্কিত ঘটনা আর্থিক খাতকে ব্যাপক দুর্বল করে ফেলেছে। ব্যাংক খাত আজ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক লুট হয়েছে। জনতা ব্যাংক লুট হয়েছে। বেসিক ব্যাংক ধ্বংস হয়েছে। পদ্মা ব্যাংক কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছে।

Saleh2

কিরণ বলেন, এই বেসামাল পরিস্থিতি উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সবল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি। কতিপয় রাজনৈতিক চক্র, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে আর আর্থিক খাতে অনিয়ম করতে না পারে তার জন্য সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

৯ মাসে রিজার্ভ থেকে হাজার কোটি ডলার বিক্রি

অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন দশ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন- ১) ব্যাংক থেকে নামে বেনামে অত্মসাধকৃত অর্থ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কারের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করা ২) অর্ধিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা ৩) ঋণ জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণ খেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের নামের তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা ৪) আর্থিক খাতে অনিয়মের সাথে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণ খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ, দেশে বিদেশে স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা করে এনবিআর ও দুদকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ প্রদান করা ৫) শুধু সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত নয়, যারা ব্যাংক দুর্বল করার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইনানুক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যাতে সরকারের ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকালীন সময়ে এইসব অসৎ ব্যক্তিরা পার পেয়ে যেতে না পারে

৬) দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষতির দায় কে নেবে তা স্পষ্ট করা। একই সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত গ্রহণ ও বিতরণ ছাড়া অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ করা ৭) দুর্বল ব্যাংকের আদায় অযোগ্য ঋণ আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ৮) ব্যাংকের কার্যক্রমের উপর অধিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম না হয় ৯) ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে হবে। যাতে মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী পর্ষদ যেন ব্যবস্থাপনা কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং ১০) ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সুফল পেতে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা। যাতে কোনো পক্ষপাতমূলক সংবাদ ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এম এম মোর্শেদ, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা, সাংবাদিক ইকবাল আহসান এবং সাংবাদিক সেলিম মালিক। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিপক্ষ দল বিজয়ী হয়।

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর