images

অর্থনীতি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৩২১ কোটি

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:৫৩ পিএম

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এক বছরের ব্যবধানে আবারও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সরকারি ছয় ব্যাংক তথা সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) এর মধ্যে শুধুমাত্র একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সামান্য কিছু কমেছে। বেড়েছে বাকি পাঁচ ব্যাংকেরই।

২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। টাকার পরিমাণ হিসেবে বেড়েছে ৯ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এছাড়াও শতকরা হিসেবে ২০২২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণ ছিল ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তবে তৃতীয় প্রন্তিকের চেয়ে কিছুটা কমেছে খেলাপি ঋণ। ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে টাকার পরিমাণের দিক থেকে সব থেকে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। ২০২৩ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৬ হাজার ৮৭৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। শতকরা হিসেবে ব্যাংটির খেলাপি ঋণ ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৬৯ হাজার ৯০৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

এরপরেই রয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২৩ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৫০১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৮৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ১১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার কোটি ৯৩ লাখ টাকা। শতকরা হিসেবে বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৯ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ১৯৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। সর্বশেষ সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ১৫০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৯৯২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। সরাকরি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতকরার দিক থেকে খেলাপি ঋণে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণে তার পরের অবস্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার কোটি ৭১৮ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে ব্যাংটির খেলাপি ঋণ ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এর পরেই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার কোটি ২০৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংটির খেলাপি ঋণ ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যা শতকরা হিসেবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

তার পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৮২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় প্রায় ৪১ কোটি ৪৫ টাকা। এক বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোর শুধুমাত্র এই ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ কমেছে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৩১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের কারণে পুরো আর্থিক খাতই একটা দুর্বল অবস্থায় আছে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, খেলাপি যেগুলো হওয়ার সেগুলো হয়ে গেছে। এখন যেগুলো বের হবে সেগুলোর হিসাব যদি ঠিক মতো করা হয়। আইএমএফ এর নির্দেশনা যদি ফলো করা হয় তাহলে হয়তো ব্যাড লোনটা কমবে। সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। একীভূতকরণের দিকে যেতে হবে। যে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব খারাপ তারা তো পারবে না। তাদেরকে রাখারও তো দরকার হয় না। এজন্য সংস্কার কার্যক্রমটা জোরেসোরে করতে হবে।

বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আর্থিক খাতের যে বিষফোঁড়াগুলো এগুলো তো কমছে না, বরং আরও বড় হয়ে যাচ্ছে। এর কারণে পুরো আর্থিক খাতই একটা দুর্বল অবস্থায় আছে। ঝুঁকির মধ্যে পড়ে আছে। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি এটা পরিষ্কার।

‘আমরা ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে একটা উদার পথে চলেছি, যারা খেলাপি করেছে তাদের কিছু সময় সুযোগ দেওয়া হয়েছে যাতে তারা টাকাগুলো ফেরত দেন, পুনঃতফসিলিকরণ, অবলোপন, পুনর্গঠন এসব পথে যাওয়া হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল যে তারা টাকা ফেরত দেবেন। কিন্তু এসব মডেল কোনো সুফল দেয়নি। বরং অনেকেই সেটার সুযোগ নিয়েছে,’ বলেন তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংক একটা রোডম্যাপ দিয়েছে সেখানে তাদের কিছু আকাঙ্ক্ষার কথা বলছে। তারা বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা বলছে, খেলাপি আদায় করবে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করবে। একিভূত করবে। সবগুলোই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। এখন পর্যন্ত এই আকাঙ্ক্ষাগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপে পরিণত হয়নি। আমাদের কথা হলো এসব অ্যাকাউন্টিং খেলা না খেলে যে ঋণ খেলাপি হয়ে আছে সেখান থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর নতুন খেলাপি ঋণ যাতে যোগ না হয় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

টিএই/এএস