জেলা প্রতিনিধি
২৩ অক্টোবর ২০২২, ০৭:০০ পিএম
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কলেজ রোডে তরুণ উদ্যোক্তা মো. সাজ্জাদুল ইসলাম আপনের বাড়ি। বাড়ির আশপাশে গেলেই কানে আসে মুরগির ডাক। কাঠ ও লোহার নেট দিয়ে তিনতলা তাক তৈরি করেছেন তিনি। এখানেই মুরগিগুলো থাকে। তাকের প্রতিটি ঘরে জাতভেদে আলাদা মুরগি রাখা।
করোনাকালে মুরগি পালন শুরু করেছিলেন। এখন তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি পুরোদস্তুর খামারি। এলাকায় ‘শখের মুরগিওয়ালা’ হিসেবে বেশ পরিচিতি তার। কেননা, এটিই তার ফেসবুক পেজের নাম। গাবতলী শহরের কলেজপাড়ায় গিয়ে ‘মুরগিওয়ালার’ খোঁজ করলে দেখিয়ে দেয় সবাই আপনের বাড়ি। এতে তিনি মন খারাপ করেন না, আনন্দিত হোন। আপন বলেন, ‘শখ থেকে শুরু করেছিলাম। এখন আমি নিজেই আয়-রোজগার করে ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া ও নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারছি। এটাই শান্তি।’
ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুরগি ও মুরগির বাচ্চা পৌঁছে দেন তিনি। দূরদূরান্ত থেকে তার কাছে ক্রেতা আসেন মুরগি কিনতে।
ভিনদেশি ১৫টি বিরল জাতের মুরগি আছে আপনের খামারে—সিল্কি, ব্রাহামা, কোচিন, বেনতাম, ফ্রিজেল, ফনিক্স, ইয়োকোহামা, অনাগাদুরি, ফাইটার, পলিশকেপ, সেব্রাইট, শো-শেরেমা, হোয়াইট ফেস, রোসকম্প ও সুমাত্রা। মুরগিগুলো নিয়মিত ডিম দেয়।
আপন জানান, সব মিলিয়ে এখন তার খামারে প্রায় চার লাখ টাকার মুরগি আছে।

আপনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বগুড়ার গাবতলীতে। বাবা মো আব্দুল কাইয়ুম তরফদার একজন স্টেশনারি ব্যবসায়ী ও মা মোছা. স্বপ্না বেগম গৃহিণী।
মেধাবী ছাত্র আপন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ২০১৭ সালে জিপিএ ফাইভ পেয়ে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০১৯ সালে বগুড়া সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। দুই ভাইয়ের মধ্যে আপন বড়।
আপনকে শুরুতে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রথম দিকে আপনের বাবা এসব একদম মেনে নিতে পারেনি। আপনকে বলতো, ‘তুমি জিলা স্কুলের ছাত্র হয়ে মুরগি বেঁচো, এইটা কোনো কথা? তুমি ইংরেজিতে অনার্স করছো আর মুরগি পালতেছো, বিক্রি করতেছো। এইটা ঠিক?’

আপন আরও বলেন, ‘একদিন আমি মুরগি ডেলিভারি দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম বাবার দোকানের সামনে দিয়ে। বাবা তখন বললো কই গিয়েছিলে? আমি বললাম কিছু মুরগি বাচ্চা ঢাকায় পাঠাইতে। উনি ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘টাকা দিয়েছে? নাকি এমনি পাঠায় দিলা? আমি বললাম, টাকা দিয়েছে বিকাশে। বাবা বিশ্বাস করতে পারেননি। আমার বিকাশের ব্যালেন্স চেক করেছেন তারপর উনি বিশ্বাস করলেন যে অনলাইনেও মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়। তখন আর কিছু বললো না, শুধু বললো, যা করছো করো। পড়ালেখা যেনো ভালো মতো হয়’।
আপন ২০১৯ সাল থেকে পড়াশোনার জন্য মেসে থাকতেন। মেসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই করোনা মহামারি শুরু হয়। এসময় মেস বন্ধ হয়ে যায়। তখন আপন বাসায় চলে আসেন। আপনের আগে থেকেই বাসায় কিছু কবুতর এবং শখের পাখি ছিল।

আপন জানান, আগে থেকেই তার পশুপাখি ভালোলাগতো। করোনার সময় সবাই গৃহবন্দি কাটিয়েছে। তখন আপন গৃহবন্দি থেকেও কবুতর, শখের পাখির পরিচর্যা এবং পড়াশোনা চালিয়ে যান।
আপন যেহেতু পাখি ও কবুতর পুষতেন তাই এই সম্পর্কিত ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত ছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি কিছু বিদেশি জাতের মুরগি ফেসবুকে দেখতে পান। এগুলো তখন তার খুব ভালোলাগে। তিনি এ মুরগিগুলোর নামও জানতেন না। পরে গ্রুপ থেকে জানতে পারেন এগুলো সিল্কি মুরগি।
আপন বলেন, ‘আসলেই এটি পৃথিবীর সুন্দর মুরগিগুলোর একটি এবং বিভিন্ন দেশে অনেক জনপ্রিয়। তারপর আমি সিল্কি মুরগির তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করলাম। অনেকেই এই মুরগির সেল পোস্ট করত ফেসবুক গ্রুপে। আমি প্রথমে দামের ধারণা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সেলারের কাছ থেকে দাম শুনতাম’।

আপন বলেন, ‘আমার অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল মুরগি নেওয়ার কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। এজন্য কিনতেও পারছিলাম না। আমি অনেকের কাছে দাম শুনেছি, কিন্তু কিনতে পারিনি। এমন সময় আমি আমার আম্মুর কাছ থেকে টাকা চাই, আম্মু আমাকে ১ হাজার টাকা দাও আমি কিছু মুরগির বাচ্চা কিনব। আম্মু কিছু চিন্তা না করেই আমাকে সেই টাকাটা দিয়ে সাহায্য করেন’।
টাকা পাওয়ার পর আপনের সমস্যা দাঁড়ায় কিভাবে সে মুরগিগুলো সংগ্রহ করবে কারণ তার টাকা অল্প আবার তিনি কখনো অনলাইনে লেনদেন করেননি। তার ভয় লাগতো টাকাটা যে কি হয়? অনলাইনের তারা যদি প্রতারক হয়। তাই আপন খুঁজতে থাকে বগুড়া জেলা বা জেলার আশেপাশে কে আছেন, কে মুরগি বিক্রি করতে চায়? হঠাৎ একদিন বগুড়ার আতাউস সামাদ রাহুল নামের একজনের পোস্ট দেখতে পারেন। পরে আপন তার বাসায় গিয়ে ১ হাজার টাকা দিয়ে ২টা ১ মাস বয়সী সিল্কি মুরগির বাচ্চা সংগ্রহ করেন।

এরপর মুরগিগুলো বাসায় এনে লালন-পালন শুরু করেন আপন। তিনি যার কাছ থেকে মুরগিগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি তাকে মুরগিগুলো লালন-পালনের দিকনির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এই মুরগির বাচ্চাগুলো বড় হতে প্রায় ৫ মাস সময় লেগে যায় আপনের।
এদের বয়স যখন ৬ মাস হয় তখন এগুলো ডিম দেওয়া শুরু করে। এদের থেকে যে বাচ্চা পেয়েছিলো তা থেকে নিজের জন্য আবার দুই জোড়া রেখে বাদ বাকি অনলাইনে বিক্রি করে দেন। আপন ২টি মুরগি থেকে ১০টা বাচ্চা বড় করেছিলেন। সেগুলোও পরবর্তীতে ডিম দেওয়া শুরু করে।
আপন বলেন, ‘তখন আমার আরও নতুন নতুন শৌখিন জাতের মুরগি সংগ্রহ করার শখ জাগে। কিন্তু মুরগি রাখার জন্য আমার কোনো জায়গা ছিল না। কবুতরের বা পাখির খাঁচায় রাখতাম। আমার বাসার ভিতরে ছোট একটা মাচার ঘর ছিল। তখন আমি চিন্তা করলাম এই জায়গায় একটা মুরগি রাখার ঘর বানাতে পারি। আমার মুরগিগুলো তখনও ডিম দিচ্ছিলো। আমি সেগুলো থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করে কিছু টাকা জমিয়ে ওই মাচার ঘরে নেট, কাঠ দিয়ে ৩ তাকের ৯টি ছোট খাঁচা বানাই। এই খাঁচাগুলো আমি এবং আমার ছোট ভাই নিজেরাই বানিয়েছিলাম। তারপর আমি আসতে আসতে নতুন জাতের মুরগি কেনা শুরু করি’।

দুই মাস আগেও মালয়েশিয়ার তিনটি শো-শেরেমা জাতের মুরগি ৩০ হাজার টাকায় কিনেছেন আপন। এগুলো এখন ডিম দিচ্ছে। ডিম থেকে বাচ্চা তুলে বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। প্রতি জোড়া শো-শেরেমা জাতের মুরগির বাচ্চা দুই–তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা যেতে পারে।
আপন বলেন, ‘কেউ যদি শখ থেকে এই মুরগি লালন–পালন করতে চান, তাহলে আমার পরামর্শ থাকবে, শুরুতেই সব বড় মুরগি কেনার দরকার নেই। দু–একটি দেশি জাতের মুরগি দিয়ে শুরু করতে পারেন। তারপর বিদেশি জাতের এক জোড়া বাচ্চা কিনলেন। আগে মুরগি পালনের কৌশলগুলো শিখতে হবে, অভ্যস্ত হতে হবে।’
>> আরও পড়ুন : প্রাইভেটকার তৈরি করে কলেজছাত্র রিশানের চমক
আপন ইতোমধ্যেই উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রদর্শনী মেলা থেকে সফল খামারি ও তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে ২টি পুরস্কার পেয়েছেন। আপনের ইচ্ছা তিনি আরও বড় আকারে একটা বিদেশি শৌখিন মুরগির খামার দিবেন। এরই মধ্যে আপন তার খামারের মাধ্যমে তার সমবয়সী ৩ জন বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
বগুড়া জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আগামী প্রজন্মের তরুণেরা পশুপালনে আগ্রহী হচ্ছেন, এটা খুবই ইতিবাচক। সরকার প্রাণী কল্যাণ আইন করছে; যেন এই প্রাণীগুলো শুধু বিনোদনের খোরাক না হয়ে ব্যবসায়িকভাবেও লাভজনক হতে পারে। যদি কোনো শিক্ষার্থী এ রকম উদ্যোক্তা হতে চান, তাহলে সরকারের রাজস্বের প্রকল্পের আওতায় এবং রাজস্ব খাত থেকে আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। সেই সঙ্গে চিকিৎসার বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দেই।’
প্রতিনিধি/এইচই