images

সারাদেশ

পদ্মার ভাঙন আবারও দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছে লৌহজংয়ের নদীর তীরবর্তী এলাকায়

জেলা প্রতিনিধি

২৬ জুলাই ২০২৫, ০৮:০৯ পিএম

বছর না ঘুরতেই আবারও তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের পদ্মা নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় যুগে যুগে পদ্মার ভাঙন নিঃস্ব করেছে শত সহস্র মানুষকে। অতীতের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি যেন কঠিন বাস্তবতা হয়ে আবারও দরজায় কড়া নাড়ছে ভাঙন কবলিত মানুষের ঘরে। ফলে শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত চলমান স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হঠাৎই আগ্রাসী রূপে পদ্মায় স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি। এতে বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা। আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল- এবারের বর্ষায় লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিবে তীব্র ভাঙন। সেই শঙ্কা সত্যি করে গত দু’দিনের বৈরী আবহাওয়ায় গতকাল শুক্রবার (২৫ জুলাই) সকাল থেকে বৃষ্টি, প্রচণ্ড বাতাস আর প্রবল স্রোতের কারণে লৌহজং উপজেলার পদ্মাপাড়ের কয়েকটি এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

thumbnail_IMG-20250726-WA0025

শনিবার (২৬ জুলাই) সকালে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার সিংহেরহাটি ও বড়নওপাড়া এলাকায় নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাঙন প্রতিরোধে অস্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ হিসেবে ফেলে রাখা জিও ব্যাগ পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে সরে যাচ্ছে।

এতে অনেক জায়গায় মাটি সরে গিয়ে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে নদীর তীরে।

স্থানীয়দের অভিযোগ প্রকল্পের কাজে ধীরগতির কারণে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙনের ঝুঁকি বেড়েছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের সাজানো সংসার চোখের সামনে মুহূর্তেই নদীতে বিলীন হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকে।

thumbnail_IMG-20250726-WA0047

স্থানীয়রা জানান, পদ্মার প্রবল স্রোত ও উঁচু উঁচু ঢেউয়ের আঘাতে অতীতের তুলনায় ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পদ্মা পাড়ের মানুষের মাঝে।

সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা যায়, সিংহেরহাটি গ্রামের দেলোয়ার দেওয়ান ভাইবোন নিয়ে পানিতে নেমে বাঁশ, কচুরিপানা, খড়কুটো দিয়ে নদীর ভাঙন থেকে বাড়িঘর ও বসতভিটা রক্ষার চেষ্টা করছেন।

আরও পড়ুন

মেঘনায় বিএনপি নেতাদের বেপরোয়া বালু উত্তোলন, ঝুঁকিতে বিদ্যুৎ প্রকল্প

তিনি জানান, গতকাল সকালে তার মৃত বাবা জয়নাল দেওয়ানের দাফন দিয়েছেন। শোকের মধ্যেই নদীভাঙন থেকে বাড়ি রক্ষায় নেমেছেন।

অন্যদিকে বড় নওপাড়া গ্রামের পুতুল আক্তার জানান, শনিবার সকাল থেকেই পদ্মার ভাঙনে জিও ব্যাগ সরে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। এর ফলে মাটি সরে গিয়ে অনেক জায়গায় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে নদী থেকে বসতভিটার দূরত্ব ও ব্যবধান তৈরি হয়েছে মাত্র এক ফুটের।

thumbnail_IMG-20250726-WA0053

আকস্মিক এই ভাঙনে সব থেকে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি।

ক্ষতিগ্রস্তরা আরও জানান, একদিকে বৈরী আবহাওয়া আর অন্যদিকে তাৎক্ষণিক শ্রমিক না পাওয়ায় ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

সিংহেরহাটি গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা কামাল বলেন, আমার বাড়িটি কনকসার-নাহেরহাট খালের উৎসমুখ পদ্মাপাড়ে। আমার বাড়ির পূর্বপাড় থেকে ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আমার বাড়ি থেকে পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের বাইরে রয়েছে। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে আজ (শনিবার) রাতটুকু থাকতে পারব কিনা জানি না।

thumbnail_IMG-20250726-WA0060

এদিকে ভাঙনের খবর পেয়ে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নেছার উদ্দিন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।

উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পদ্মানদীর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পদ্মা সেতুর ভাটিতে বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় পর্যন্ত পদ্মা নদীর ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার তীর এলাকায় চলছে স্থায়ী ও সতর্কতামূলক বাঁধ নির্মাণের কাজ।

এর মধ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার এবং সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙন প্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ রাখা স্থান) ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার। ২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে। তখন ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ বরাদ্দ ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা।

পরে বাঁধ নির্মাণের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে করা হয় ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার। আর ৪৪৬ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে অর্থ বরাদ্দ করা হয় ৪৭০ কোটি টাকা।

thumbnail_IMG-20250726-WA0042

সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে পুনরায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫২৭ কোটি টাকা করা হয়। সেই সাথে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর। বর্ষা মৌসুমের আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ ধীর গতিতে শঙ্কিত পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা।

বিগত আড়াই দশকে দুই উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম বিলীন হয়েছে পদ্মার নদীগর্ভে। ভিটেমাটি, জমিজমা হারিয়েছেন অর্ধ লাখ পরিবার।

গাঁওদিয়া গ্রামের কাজী বাবুল বলেন, পদ্মার ভাঙনে দুই দশক আগে বসতবাড়ি, জমাজমি হারিয়ে বর্তমানের স্থানে আছি। এখান থেকে নদী মাত্র ১০০ মিটার দূরে। বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ হলে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু প্রকল্পের কাজের ধীরগতি ও সুনির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় ভাঙন ঝুঁকি ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়।

কনকসার খালের মুখে পদ্মাতীরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, আমার বাড়ি থেকে পশ্চিমে ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে, তাই শঙ্কায় আছি। গত বছর ঢেউয়ের আঘাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে নিশ্চিন্ত হতাম।

thumbnail_IMG-20250726-WA0063

মুন্সিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৪৮ শতাংশ। ২৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে,উপ-সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক জানান, প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৮৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে  প্রতিরক্ষা কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটার এবং সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙন প্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ রাখা স্থান) ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার। এছাড়া ১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বহির্ভূত এলাকা রয়েছে ১ দশমিক ৮৫০ কিলোমিটার।

নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে, ভাঙন প্রতিরোধে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রকৌশলী এনামুল হক আরও বলেন, স্থায়ী বাঁধে কিংবা সতর্কতামূলক স্থানে ভাঙন দেখা দিলে সেই বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রতিনিধি/এসএস