মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি ও নির্মাণ করা বাঁধ ঘেঁষে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দীর্ঘ একমাস ধরে ড্রেজার দিয়ে বেপরোয়াভাবে লাগাতার চলছে বালু উত্তোলন। এতে ধসে পড়তে শুরু করেছে প্রকল্প রক্ষাবাঁধ। বিলীন হুমকিতে প্রকল্পটি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন,৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের বাঁধ ঘেঁষে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে যেকোনো দিন প্রকল্প রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিলীন হতে পারে ভরাট জমি।
বিজ্ঞাপন

অভিযোগ উঠেছে,বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক একান্ত সচিব মিয়া নুরুদ্দিন অপু মুন্সিগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান,জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওরফে জসিমসহ বিএনপির নেতাদের একটি সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় বালু উত্তোলনের কাজটি করছেন।
কোল ফায়ার্ড থারমাল পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পের আওতায় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নামে রাষ্ট্রীয় একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রটি নির্মাণের দায়িত্ব পান।

বিজ্ঞাপন
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ ও গজারিয়ার শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং সরকারের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০১৬ সালে ৩৫০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের জন্য গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নে মেঘনা নদীর তীরে ষোলআনি ও দৌলতপুর দু'টি মৌজায় ২৫৪.০১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ, অধিগ্রহণকৃত জায়গায় বালু ভরাট, জায়গা রক্ষার জন্য চতুর্দিকে ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে খরচ হয় ৪০০ কোটি টাকা।
জি টু জি ভিত্তিতে চীন সরকারের অর্থায়নে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের কথা থাকলেও পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিল করে গ্যাস ভিত্তিক ৬০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দেশে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি থাকায় অধিগ্রহণকৃত ২০০ একর জমিতে একটি ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অবশিষ্ট জমিতে পরবর্তীতে ৬০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার কথা ছিল। অথচ বেপরোয়া বালু কাটার ফলে প্রকল্পটি এখন হুমকির মুখে।

সরেজমিনে শুক্রবার (২৫ জুলাই) দুপুরের দিকে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প রক্ষাবাঁধের ৬০ থেকে ৭০ ফুট দূরত্বে ৩৫ থেকে ৩০টি ড্রেজার তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে দেদারসে বালু কাটছে।
সে বালু বাল্কহেডে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হচ্ছে। নির্বিঘ্নে বালু উত্তোলনের জন্য রাখা হয়েছে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সস্ত্র দল।
যারা বালু উত্তোলনের পাশেই একটি ট্রলারে করে মহড়া দিচ্ছিলেন। প্রকল্পের রক্ষা বাঁধটি নদী থেকে অন্তত ২০ ফুট উঁচুতে। এদিন প্রকল্পের ওপরে উঠতে গিয়ে বাঁধে ফাঁটল দেখা যায়। কিছু অংশে বাঁধের ব্লকও ধসে পড়েছে।

এসময় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, যারা বালু উত্তোলন করছে তারা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাস খানেক ধরেই নির্মাণাধীন প্রকল্পটির পাশ ঘেঁষে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার কারণে এখন বাঁধসহ পুরো প্রকল্পটি হুমকির মুখে পড়েছে। যেকোনো সময় বাঁধসহ প্রকল্পের জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। এসময় তারা আক্ষেপের সঙ্গে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দীর্ঘদিন বালুমহাল ইজারার নামে প্রকল্পটির আশপাশে গ্রাম ঘেঁষে অবৈধভাবে বালু কেটেছেন আওয়ামী লীগের লোকজন।কখনও প্রকল্পের দিকে আসেননি।

বিএনপির লোকজন এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে তারা কােনো কিছুই মানছেন না। যারা বালু কাটছেন তাদের সঙ্গে নদীতে ট্রলারে অস্ত্রধারী থাকেন। স্থানীয় কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পান না। প্রতিবাদ করতে গেলে লাশ হতে হবে।
রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, জমি অধিগ্রহণ থেকে ভূমি উন্নয়নের সব কাজ নিজেরা উপস্থিত থেকে করেছি। দীর্ঘ চার বছর শ্রম আর ঘাম দিয়ে প্রকল্পের জটিল ও মূলকাজটি শেষ করা হয়।
![]()
প্রকল্পের সুরক্ষার জন্য বাঁধ থেকে ১০০ ফুট নিচে নদীর তীর পর্যন্ত বড় বড় কংক্রিটের ব্লক স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। বাঁধের চারদিকে এতটাই মজবুত করা হয়েছিল যা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও কোনো ক্ষতির সম্ভবনা ছিল না। অথচ বালু দস্যুরা নদীর তীর কেটেছে, স্তূপ করা ব্লকের জায়গা গুলো কেটেছে, এখন বাঁধ ঘেঁষে বালু কাটছে। তাদের লোভে শতশত কোটি টাকার প্রকল্প হুমকির মুখে। যেভাবে বালু কাটা হচ্ছে সেটা বন্ধ করা না হলে কিছুদিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে নয়ানগর, রমজানবেগ, চরকালীপুরা ও ষোলআনি মৌজায় ১২৮ একর নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। গত বছরও এ মৌজাগুলোতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছিল। এবার বালুমহালটি ২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন আদন ড্রেজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
![]()
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মালিক মিয়া নুরুদ্দিন অপুর বড় বোন সেলিনা আক্তার। তবে মহালটি বিএনপি নেতাদের দিয়ে পরিচালনা করছেন মিয়া নুরুদ্দিন অপু।ইজারা প্রতিষ্ঠানকে নদীর তীর থেকে ৬০০ ফুট গভীরে বালু উত্তোলনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। তবে কোনো শর্ত না মেনেই নদীর তীর ও ইজারার বাহিরের এলাকায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
ইজারার শর্তেও রয়েছে ইজারার বাহিরে বালু উত্তোলন করা যাবে না। ইজার সীমানার ৫০ গজ ভেতর থেকে বালু উত্তোলন করতে হবে। এছাড়াও সেতু, সড়ক, মহাসড়ক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি প্রকল্পের স্থান থেকেও বালু উত্তোলন করা যাবে না।
প্রকল্প ঘেঁষে ইজারার বাইরে গিয়ে বালু কাটার বিষয়ে জানতে মিয়া নুরুদ্দিন অপুর মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। আলাদা আরও একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন দিলে সেটি সক্রিয় থাকলেও তিনি ধরেননি।
স্থানীয়ভাবে পরিচালনার দায়িত্ব থাকা সাবেক যুবদল নেতা মুজিবুর রহমানকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি পরিচালনার সঙ্গে নেই। এসব বিষয় জানে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম।
আমিনুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি মিয়া নুরুদ্দিন অপুর পরিচালনা এবং স্থানীয়ভাবে তিনি ও মজিবুর রহমান দায়িত্বে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে আমিনুল ইসলামের দাবি তারা নদীর ৬০০ ফুট গভীর থেকে বালু কাটেন। সেখান থেকে তাদের লোকজনকে বালু কাটার জন্য বলে দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে প্রকল্পটি বালু দস্যুদের লালসা থেকে রক্ষা করতে চলতি বছরের মার্চে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেন প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভুঁইয়া। সব শেষ গত ২৯ জুনও একটি চিঠি দেন এই কর্মকর্তা। একই চিঠির অনুলিপি পুলিশ সুপার, গজারিয়ার ইউএনও ও ওসিকেও দেওয়া হয়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এর মধ্যে গত কয়েকদিন আগে এই কর্মকর্তা অবসরে চলে যান।
![]()
বর্তমানে প্রকল্পটির নির্বাহী পরিচালক ড. সুসান্ত কুমার সাহা প্রকল্প ভিলেনের শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রকল্পটি রক্ষায় আমরা মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। এর পরেও বাঁধ ঘেঁষ বালুকাটা থেমে নেই। ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প রক্ষা করতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এদিকে অবৈধভাবে বালুকাটা বন্ধের কিছুদিন আগে গজারিয়ার মহালে অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানান মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফাতেমাতুল জান্নাত। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গিয়ে কোনো অবস্থাতেই বালু কাটা যাবে না। যদি এরপরও তারা সীমা লঙ্ঘন করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস

