২৫ জুন ২০২৫, ১০:৫৭ এএম
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী এখন এরোমোনাস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। ফলে একের পর এক মা মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র মারা যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, কোরবানির পশুর চামড়া ও বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, ঈদের পর এখন পর্যন্ত চারটি মৃত কাতলা মা মাছ হালদা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এই মাছগুলো ছিল জাতির জন্য অতুলনীয় সম্পদ।
তিনি বলেন, কোরবানির সময় বিক্রি না হওয়া চামড়া এবং পশুর মলমূত্র নদীতে ফেলা হচ্ছে, যা ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারের অন্যতম কারণ। এর ফলে মা মাছসহ নদীর বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ২২ জুন, রোববার বিকেলে হাটহাজারী উপজেলার রামদাস মুন্সীর হাট এলাকা থেকে দুটি মৃত মা মাছ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর আগে একই দিন সকালে স্থানীয়রা আরও একটি মৃত মা মাছ উদ্ধার করে মাটিচাপা দেয়। এর তিন দিন আগেও একটি মাছ উদ্ধার করা হয়।
এই মাছগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এরোমোনাস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তারা মারা গেছে। তাদের ত্বকে লাল রঙের ঘা, পাখনার গোড়ায় পচন, ফ্যাকাশে ফুলকা, ফোলা পেট ও চোখ— এসব উপসর্গ দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৯ মে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছেড়েছে। এরপর প্রজননজনিত শারীরিক দুর্বলতায় ভোগা মাছগুলো সহজেই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের শিকার হয়।
পশুর বর্জ্য ও চামড়াই মূল কারণ
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল আজহার পরদিন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার তেরপারি খালে স্থানীয়রা পশুর নাড়িভুঁড়ি ও অবিক্রিত চামড়া ফেলে দেন। পরে প্রায় ৭০০ চামড়া শ্রমিকদের মাধ্যমে তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা হলেও, অনেক চামড়া পচে নদীতে গিয়ে পড়ে।
এই খালের মাধ্যমে হালদা নদীতে সরাসরি বর্জ্য প্রবাহিত হয়, ফলে নদীর রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ জাতীয় মা মাছ, জলজ উদ্ভিদসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ে।
এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে ফটিকছড়ি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমান বলেন, ‘গত বছরও একই ঘটনা ঘটেছিল। কোরবানির ঈদের পর হালদা নদীতে সাতটি মা মাছ মারা যায়। ভবিষ্যতে হালদা নদীতে কেউ যাতে কোনো ধরনের বর্জ্য ফেলতে না পারে, এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
আরও পড়ুন—
এক মা মাছের আয় ৪ কোটি টাকা
গবেষকদের মতে, হালদা নদীর একটি মা মাছ থেকে বছরে আয় হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। একটি মা মাছ গড়ে ১৬ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এর মধ্যে প্রায় ১০ বছর ধরে সে পরিপূর্ণ ডিম দিয়ে থাকে। সেই ডিম থেকে রেণু এবং রেণু থেকে বড় মাছ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপ বিবেচনায় নিয়ে এ আয় হিসাব করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সাত বছর বয়সী ও ১৮ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছের আর্থিক অবদান নিরূপণে গবেষণা চালানো হয়। এই মাছকে নমুনা হিসেবে ধরে হালদা নদীতে গত ১০ বছরে প্রাপ্ত মা মাছ ও ডিমের গড় নির্ণয় করা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এবং হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বয়স ও ওজন অনুযায়ী একটি মা মাছ প্রতিবছর গড়ে ৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। এই ডিম থেকে ফোটা রেণুগুলো বিভিন্ন ধাপে বিক্রি হয়। এক কেজি রেণুর দাম সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
প্রথম ধাপে ডিম থেকে চার দিনের মধ্যে রেণু ফোটে। দ্বিতীয় ধাপে, ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে এই রেণুগুলো “ধানী পোনা” হিসেবে বিক্রি হয়। তৃতীয় ধাপে, এক থেকে দুই মাস বয়সী এই পোনাগুলো “আঙ্গুলি পোনা” রূপে বাজারজাত করা হয়। চতুর্থ ধাপে একটি রেণু পরিপূর্ণ মাছে পরিণত হয়।
প্রতিটি ধাপে প্রায় ৪০ শতাংশ হারে মৃত্যু ধরে গবেষকরা মাছটির আর্থিক মূল্য নিরূপণ করেছেন। তাঁদের হিসাবে, এই একটি কাতলা মাছই গত পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২০ কোটি টাকা যুক্ত করেছে।
হালদার অবদান
হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছর হালদা নদী থেকে ১৪ হাজার ১৬৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি বেশি। ২০২৪ সালে হালদা থেকে ১০ হাজার ৬৬০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর আগে, ২০২৩ সালে সংগ্রহ হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি, আর ২০২২ ও ২০২১ সালে ছিল এর চেয়েও কম। তবে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা ছিল গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি ৬০ কেজি ডিম থেকে গড়ে ৪ দিন বয়সী ১ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়। সব মিলিয়ে হালদা নদী থেকে বছরে প্রায় ৮২১ কোটি ১০ লাখ টাকার টার্নওভার হয়, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।’
আরও পড়ুন—
বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ‘হালদা নদী খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার বদনাতলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। হালদার মূল স্রোতের সঙ্গে বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া মিশে একে সমৃদ্ধ করেছে। উৎসমুখ থেকে শুরু করে এতে ২০টি বড় খাল বা ছড়া এবং প্রায় ৩৪টি ছোট পাহাড়ি ছড়া মিলিত হয়েছে।’
হালদাকে কেন্দ্র করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দুই তীরের প্রায় ১ হাজার ৫৪৪ জন জেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হালদা নদীর ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করেন। এছাড়াও রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮৯ জন ডিম সংগ্রহকারী, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৫২৪টি নৌকা প্রতি বছর ডিম সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি নৌকার জন্য প্রতি বছর খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। জেলেরা নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করে তা সারাদেশে বিক্রি করেন।
এবিএম মশিউজ্জামান আরও বলেন, ‘হালদার মাছ খুব দ্রুত বড় হয় এবং এটি অত্যন্ত সুস্বাদু। তাই এ জাতীয় মাছের চাহিদা সারাদেশে বেশি। নদী থেকে সংগৃহীত ডিম থেকে রেণু ফুটিয়ে বিক্রি করে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন আবুল কাশেম। বছর দশেক আগেও তাঁর ছিল একটি কুঁড়েঘর। এখন তাঁর নিজস্ব নৌকাও রয়েছে। এছাড়াও পরিমল, জাহাঙ্গীরসহ অনেকের জীবন বদলে গেছে।’

প্রয়োজন জনসচেতনতা
চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, হালদা নদী দেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের বিশাল খনি। একে সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে হালদাকে যে কোনো দূষণ থেকে বাঁচাতে হবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করতে হবে। এ জন্য হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলা প্রশাসনকে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিনিধি/একেবি