images

সারাদেশ

ফড়িয়াদের কব্জায় চট্টগ্রামের বোরো ধান, লক্ষ্যমাত্রার ৬০ ভাগ সংগ্রহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ জুন ২০২৫, ১১:৩৪ এএম

বরাবরের মতো এবারও ফড়িয়াদের কব্জায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিলে উৎপাদিত বোরো ধান। সরকারি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬০ দশমিক ৬৬ ভাগ বোরো ধান সংগ্রহ হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যা ধান সংগ্রহে রেকর্ড বলছে খাদ্য অধিদফতর।

শনিবার (১৪ জুন) এ তথ্য জানান চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়সার আলী। তিনি বলেন, গত আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের সংগ্রহ ছিল একেবারে হতাশাজনক। ফলে সরকার এবার ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য গতবারের চেয়ে কেজিতে চার টাকা করে বাড়িয়েছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। দুই মিলে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের সংগ্রহ আশাব্যঞ্জক সাফল্য পেয়েছে। হতাশা কাটিয়ে লক্ষ্যমাত্রার ৬০.৬৬ ভাগ বোরো ধান সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

তিনি বলেন, বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম সফল করতে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা সরকারি নির্দেশনা পালন করেছেন। এবার ভালো ও ন্যায্য দামে সরকারকে ধান দিতে পেরে কৃষকরাও খুশি হয়েছেন।

খাদ্য অধিদফতর জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪৬ হাজার ৮০৫ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে গত ১১ জুন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে ২৮ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬০ দশমিক ৬৬ ভাগ মাত্র।

আরও পড়ুন

মেডিয়েশনে ৩.৫ মিলিয়ন ডলার পেল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন

সূত্রমতে, গত ২৪ এপ্রিল থেকে বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান কিনছে কেজিতে ৩৬ টাকা করে। আর মিল মালিকের কাছ থেকে আতপ চাল কেজিতে ৪৮ টাকা ও সেদ্ধ চাল কেজিতে ৪৯ টাকায় কিনছে।

কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৮ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। ধান উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৯৭ হাজার টন। গতবারের তুলনায় আবাদ বেড়েছে ৭ হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে। আর ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৪৭ হাজার ৬৬৩ টন। এরপরও চট্টগ্রামে চালের চাহিদা পূরণ হবে না। কারণ এই অঞ্চলে উৎপাদিত ধানের একটি অংশ চলে গেছে উত্তরবঙ্গের ফড়িয়াদের কাছে। 

বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি) মো. ফখরুল আলম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ধান চাষাবাদ কম হয় তা নয়, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী যা হয় তা দিয়ে চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রামের চিত্র পুরোটাই উল্টো।

তিনি বলেন, সারাবছরই দেশের উত্তরবঙ্গ থেকে চাল আনতে হয়। আর যে চাল আনা হয় তা চট্টগ্রামে উৎপাদিত ধানেরই চাল। চট্টগ্রামের মানুষ সেদ্ধ চাল খাই না। আতপ চাল খাই। আবার উত্তরবঙ্গের মানুষ আতপ চাল খাই না। আর সেই আতপ চাল উত্তরবঙ্গের চালকলগুলো থেকে চড়া দামে সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রামে।

বিশেষ করে বোরো ধানের চালগুলোকে উত্তরবঙ্গের চালকলে সরু করে রাসায়নিক মিশ্রণের মাধ্যমে ধবধবে সাদা করে মিনিকেট, কাটারি, নাইজারসহ নানা নামে বস্তাবন্দি করে চট্টগ্রামের বাজারে পাঠায়। যা খেয়ে চট্টগ্রামের মানুষ নানারকম পেটের পীড়ায় ভোগে। অথচ কৃষকরা সচেতন হলে ফড়িয়াদের এই ফাঁদ থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করা সম্ভব।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামে চামড়ার রেকর্ড সংগ্রহ, বাজারে নজিরবিহীন নৈরাজ্য

তিনি বলেন, সরকার বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কেজিপ্রতি ৪ টাকা দাম বাড়ালেও ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা তার চেয়েও ৩-৪ টাকা বেশি দামে ধান কিনছে। ফলে চট্টগ্রামের কৃষকরা নিজের চাহিদার অতিরিক্ত ধান ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করছে।

বিষয়টি জানতে চাইলে চট্টগ্রামের শস্যভান্ডার গুমাইবিলের কৃষক ও স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. জহির বলেন, গুমাইবিলে আমি এক একর তিন শতক বোরো ধানের চাষ করেছি। ধান কাটার সময় ক্রেতা এসে উঠান থেকে কেজিপ্রতি ৩৯ টাকা দামে কিনেছে। ধান ক্রেতা উত্তরবঙ্গের বলে জানান তিনি।

একই কথা বলেছেন গুমাইবিলের কৃষক মরিয়মনগর কাটাখালি এলাকার আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, সরকারি দামের চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি দামে ধান বিক্রি করেছি। এক হাজার ৬০০ কেজির মতো ধান বিক্রি করেছি আমি। কম দামে সরকারকে কেন দেব? এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, আর্দ্রতার নামে ৩০-৪০ শতাংশ ধান বাদ দেয় খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য গুদামে এভাবে কৃষকদের ঠকানো হয়। অন্যদিকে সরকারের চেয়ে ফড়িয়ারা ধানের ভালো দাম দেয়। খেত বা উঠান থেকে নিয়ে যায়। তাই কৃষকেরা তাদের কাছে ধান বিক্রিতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে সাতকানিয়া উপজেলার খাগড়িয়া বিলের কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের সব কাজে দুই নাম্বারি, সরকারের একেক কর্মকর্তা কোটি টাকার মালিক। কিন্তু ধান কেনার সময় এক নাম্বার চাই। গরিব কৃষকদের রক্ত খেতে পারলে তারা খুশি। তাই কৃষকরাও সরকারকে ধান দেয় না। সবাই লাভ বুঝে, কৃষকরা বুঝবে না কেন?। এতে কার কি আসে যায় তা দেখার দায়িত্ব কি শুধু কৃষকদের।

সম্প্রতি আনোয়ারা উপজেলার চরতি এলাকায় ধান কিনতে আসা এক ফড়িয়া ব্যবসায়ীর দেখা হয়। এ সময় তার সাথে ছিলেন স্থানীয় আরও দু’জন ব্যবসায়ী। যারা চরতি বিলের কৃষক এনামুল হক, আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন কৃষকের সাথে ধান কেনা নিয়ে কথা বলেন। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে ধান কিনেন তিনি।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামে আরও এক যুবকের শরীরে করোনা শনাক্ত 

এ সময় তিনি উত্তরবঙ্গের কুষ্টিয়া চালকলের মালিক বলে পরিচয় দেন। নিজের নাম শাহ জামাল বলে জানান। তিনি বলেন, আমরা তো ব্যবসা করছি। চট্টগ্রামে উন্নতমানের তেমন চালকল নেই। তাই ধান মজুদ তেমন করা হয় না। কিন্তু আমাদের চালকলগুলো অনেক উন্নত মানের। তাই আমরা মজুদ করি। সরকারের চেয়ে একটু বেশি দামে ক্রয় করি বলে কৃষকরাও আমাদের কাছে ধান বিক্রি করে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। খরচ বাদ দিয়ে স্বল্প লাভে আমরা এসব চাল চট্টগ্রামের বাজারে সরবরাহ করি। আমরা সরবরাহ না করলে চট্টগ্রামের চালের বাজারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো।       

এ নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মু. নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কৃষক যাতে ধানের ভালো দাম পায়। কৃষক ভালো দাম পাচ্ছে। তবুও অনেক ধান ফড়িয়াদের কব্জায় চলে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমদ বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা সেদ্ধ চাল চট্টগ্রামের মানুষ খাই না। তাই দেশের অন্য জেলা থেকে চাল সংগ্রহ করে এখানকার চাহিদা মেটাতে হয়। আবার চট্টগ্রামে চাল কল তেমন নেই বললেই চলে। ফলে ধানের মজুদ তেমন হয় না। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে উত্তরবঙ্গের চালকল মালিকেরা। ফলে চট্টগ্রামে ধানের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা কখনোই অর্জিত হয় না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত আমন মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৮১৮ টন। বিপরীতে ধান সংগ্রহ হয়েছে ২৮৬ টন। যা ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ মাত্র। সেই হিসাব বিশ্লেষণ করলে এবার বোরো মৌসুমেও ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না।       

প্রতিনিধি/এসএস