সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চট্টগ্রামে চামড়ার রেকর্ড সংগ্রহ, বাজারে নজিরবিহীন নৈরাজ্য

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২৫, ০২:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

চট্টগ্রামে চামড়ার রেকর্ড সংগ্রহ, বাজারে নজিরবিহীন নৈরাজ্য

# পঁচে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ চামড়া
# সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বিনামূল্যে সংগ্রহ করেছে অধিকাংশ চামড়া
# মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম লোকসানে

চট্টগ্রামে এবারের কোরবানিতে রেকর্ডসংখ্যক পশুর চামড়া সংগ্রহ হলেও বাজারে ছিল না তার কোনো প্রতিফলন। সিন্ডিকেটের দখলে চলে যাওয়া অধিকাংশ চামড়া গিয়েছে মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় সংগঠনের হাতে—বিনামূল্যে। অপরদিকে, দাম না পেয়ে হাজার হাজার চামড়া পচে গেছে রাস্তায় বা ফেলে দেওয়া হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কোরবানিদাতারা, যারা শেষ পর্যন্ত চামড়া তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন কোনো মূল্য ছাড়াই।


বিজ্ঞাপন


চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বৃহস্পতিবার (১২ জুন) এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় এবারে গরু ও মহিষের চামড়া সংরক্ষিত হয়েছে ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫৬টি এবং ছাগলের চামড়া ৭৪ হাজার ৩০২টি।

এর মধ্যে ৬ লাখের বেশি চামড়া বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ড বিনামূল্যে সংগ্রহ করেছে। আর চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় ৩০টি আড়তে সংরক্ষিত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার চামড়া, যা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন এসব মৌসুমি ব্যবসায়ী।

সমবায় সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় বিভিন্ন জেলায় সংরক্ষিত চামড়ার সংখ্যা নিম্নরূপ:

চট্টগ্রাম: ২ লাখ ৭২ হাজার ১০০টি, কুমিল্লা: ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৭৫টি, নোয়াখালী: ১ লাখ ১৩ হাজার ৮৩১টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ৯৯ হাজার ৭৮১টি, কক্সবাজার: ৩৭ হাজার ৮৮৯টি, চাঁদপুর: ২৩ হাজার ৬৫টি, ফেনী: ১৩ হাজার ৫০৯টি, লক্ষ্মীপুর: ১১ হাজার ৮৩৭টি, খাগড়াছড়ি: ৫ হাজার ৮৫৯টি, রাঙামাটি: ২ হাজার ৮৪৮টি, বান্দরবান: ২ হাজার ২৯২টি।


বিজ্ঞাপন


এই পরিসংখ্যান বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭৫ হাজার চামড়া সংরক্ষণ হয়েছিল। তখন চামড়ার অর্ধেক চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়েছিল বলে জানা যায়। এবার সীমান্তে কড়াকড়ি এবং ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে বেশিরভাগ চামড়া দেশে সংরক্ষিত হয়েছে।

তবে চামড়ার দাম না পাওয়ায় ৫০-৬০ হাজার চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর জানান, এবার চট্টগ্রাম বিভাগে প্রায় ৯ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এতিমখানা, মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে ২-৩ মাস কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।

তবে অভিযোগ রয়েছে, এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় সংগঠন সংশ্লিষ্টরা সংঘবদ্ধভাবে চামড়া সংগ্রহ করে কোরবানি দাতাদের কোনো অর্থ না দিয়ে তা বিক্রি করেছেন। খোঁজ নিয়ে মিলেছে অভিযোগের সত্যতাও। 

সরকার নির্ধারিত মূল্যে (ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা) বিক্রির কথা থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ লেনদেন হয়েছে বিনামূল্যে বা খুব কম দামে।

কোরবানি দাতাদের ভাষ্য, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সিন্ডিকেটের কারণে এক টাকা মূল্যও পায়নি কোরবানি দাতারা। এতিমখানা, মসজিদ-মাদরাসার পাশাপাশি ইসলামি সমাজ কল্যাণ সংস্থা, ইসলামি ফ্রন্ট ও গাউছিয়া কমিটি সম্পূর্ণ বিনামুল্যে হাতিয়ে নিয়েছে কোরবানির পশুর অধিকাংশ চামড়া। যা তারা আড়তে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছে।  

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা খালেদ মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ গরিবের হক। কিন্তু গত ১৭-১৮ বছর গরিবের সেই হক লুটে খেয়েছে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা। এবার সেই হক লুটে নিয়েছে জামায়েত ইসলামি পরিচালিত সংগঠন ইসলামি সমাজ কল্যাণ সংস্থা, ইসলামি ফ্রন্ট ও তাদের পরিচালিত সংগঠন গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ। 

নগরীর হালিশহর হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এলাকায় কোনো ক্রেতা আসেনি। কেবল দুই-একজন মাদরাসার প্রতিনিধি এসে চামড়া চেয়েছেন। তাও বিনামুল্যে। শেষ পর্যন্ত আমরা ইসলামি সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে দিয়ে দিয়েছি।

নগরীর বালুচড়া এলাকার মিট বাজারের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শেয়ারে ২২টি গরু কোরবানি দেওয়া হয়। ঈদের দিন শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত একজন ক্রেতাও আসেনি চামড়ার জন্য। ফলে রাত দশটার দিকে খুলশী এলাকার একটি এতিমখানায় ফোন করলে তারা এসে বিনামুল্যে চামড়া নিয়ে যায়।

নগরীর অক্সিজেন এলাকার বাসিন্দা সারওয়ার জাহান জানান, সরকারি দরে ২০ বর্গফুটের একটি চামড়ার মূল্য প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু আমি এক ব্যবসায়ীর কাছে মাত্র ৪০০ টাকায় সেই চামড়া বিক্রি করেছি। আমার আশপাশের কেউ চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। সবাই বিনামুল্যে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন—

chamra-2

উপজেলা পর্যায়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর চামড়া সংগ্রহ করলেও এবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও মৌসুমি ক্রেতারা চামড়া কিনতে আসেনি। তাই বাধ্য হয়ে আশপাশে মাদরাসাগুলোতে বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন বলে জানান কোরবানি দাতারা।

জেলার মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, ঈদের আগের দিন চামড়া কেনার জন্য দু‘জন ব্যক্তি চামড়ার বুকিং দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সকালে তারা জানিয়ে দেয় চামড়া কিনবে না। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। পরে পার্শ্ববর্তী একটি মাদরাসায় দিয়ে দিয়েছি। 

তিনি জানান, আশেপাশে প্রায় ১৩টি গরু জবাই হয়েছে। কেউ কেউ মিঠাছড়া বাজারে চামড়া নিয়ে গিয়ে ১০০ টাকায় বিক্রি করেছে। এবার চামড়া গত বছরের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হওয়ার কথা শোনা গেলেও পরিস্থিতি আগের বছরগুলোর তুলনায় নাজুক।

সরকার ঢাকায় লবণ দেওয়া গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করলেও চট্টগ্রামে বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ব্যবসায়ীদের দাবি, অধিকাংশ লেনদেন হয়েছে বিনামুল্যে বা অনেক কম দামে। 

স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী কবির আহমদ বলেন, আমি গত ১৫ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসায় জড়িত। এবার প্রতিটি চামড়া গড়ে ৪০০ টাকায় কিনেছি, কিন্তু আড়তদাররা কিনেছেন ২০০-২৫০ টাকায়। এতে লোকসানের মুখে পড়েছি। আবার বিক্রি করতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় চামড়া ফেলে চলে গেছে। 

নজরুল ইসলাম নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, আমি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একটি মাদরাসা থেকে ৭০০ পিস চামড়া কিনেছি প্রতি পিস ২০০ টাকা করে। এ চামড়াগুলো রাত ১২টার দিকে আতুরার ডিপো আড়তে নেওয়ার পর কোনো আড়তদার কেনার আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ৫০ টাকায়ও এসব চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। এ কারণে আতুরার ডিপো এলাকায় সড়কের পাশে এসব চামড়া ফেলে এসেছি।

চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্ম্মা বলেন, নগরীর আতুরার ডিপোতে প্রচুর চামড়া নষ্ট হয়েছে। আগ্রাবাদ চৌমুহনী, দেওয়ানহাটেও পেয়েছি, মুরাদপুরেও পেয়েছি। ৫০-৬০ হাজারেরও বেশি চামড়া আমরা আবর্জনার ভাগাড়ে নিয়ে ফেলেছি। যদিও চট্টগ্রামে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৬২০টি চামড়া পচিয়ে ফেলেছে বলে দাবি করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। 

গত মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে নাটোরের চকবৈদ্যনাথ এলাকায় চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা এই দাবি করেন। যা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। 

এত চামড়া নষ্ট হলো কেন জানতে চাইলে আড়তদাররা বলেন, একদিকে শ্রমিক সংকট, অন্যদিকে রিফ লেদার নামে একটি মাত্র ট্যানারি রয়েছে চট্টগ্রামে। যেখানে এক লাখের বেশি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব নয়। চট্টগ্রামে এক সময় ২২টি ট্যানারি ছিল। এ কাজে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ২০-২৫ হাজার মানুষ জড়িত ছিল। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্রের কারণে চট্টগ্রামের সেই কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত। 

chamra

অন্যদিকে চামড়া ঢাকায় পাঠালেও টাকা বাকি থেকে যায়। এতে চামড়া মজুদে সামর্থ্য হারায় আড়তদাররা। ফলে গত এক দশকে দুই শতাধিক আড়তদার থেকে কমতে কমতে এখন ২৮-৩০ জনে ঠেকেছে। যার প্রভাবে চট্টগ্রামে চামড়া এখন বর্জ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর