জেলা প্রতিনিধি
২৫ মে ২০২৫, ০৬:৪৬ পিএম
প্রকৃতিগতভাবে মানুষ নিয়ত ভালোবাসার অন্বেষণে ব্যস্ত। সৃষ্টির প্রতি প্রেম মূলত স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। একইসাথে কোনো এলাকা বা অঞ্চলকে ভালো লাগার মূল কারণ হচ্ছে সেখানে থাকা প্রিয় মানুষের স্মৃতি। ঠিক একইভাবে কুমিল্লা হচ্ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভালোবাসার শহর।
এ জেলা তাকে দিয়েছে প্রেম ও বিরহ। সাধারণ মানুষের জীবনে প্রেম দরকার। তবে কবিদের জীবনে ভালোবাসা আরও বেশি করে প্রয়োজন। যার মধ্যে প্রেম রয়েছে, তার মধ্যে সৃজনশীলতাও রয়েছে। তাইতো কবিরা বারবার প্রেমে পড়ে।
মহাকবি নজরুলের ভালোবাসা-বিরহ এবং কাব্যিক চেতনার উন্মেষে কুমিল্লা শহর একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এ শহরের নাম। কুমিল্লার পথে-প্রান্তরে রয়েছে তার অসংখ্য স্মৃতি। এ শহরই নজরুল,নার্গিস ও প্রমিলাকে একসূত্রে গেঁথেছে।
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো/তবু আমারে দেবো না ভুলিতে...। ’—এ চরণ দু’টিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরভাস্বর হয়ে আছেন কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে। এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নজরুলের রয়েছে অটুট বন্ধন। তার প্রেম-বিরহ, বিয়ে, সংগীত-সাহিত্য চর্চা ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে কুমিল্লার সঙ্গে। মানবতা, সাম্য ও বিদ্রোহের কবি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য কর্মের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এ জেলা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদে অবস্থান করেন। এখানে পরিচয় হয় কুমিল্লার মুরাগনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে। আলী আকবর খান নজরুলকে তার গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিলে কবি তাতে রাজি হয়ে যান। পরে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন তিনি।
আলী আকবর খানের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুর বেশ দূরত্ব হওয়ায় এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা তেমন ভালো না থাকার দরুন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে যাত্রাবিরতি করেন নজরুল।
আরও পড়ুন: আজ ঔপন্যাসিক শফীউদ্দীন সরদারের ৯০তম জন্মবার্ষিকী
বীরেন্দ্র কুমার সেন ছিলেন আলী আকবর খানের ছাত্রজীবনের বন্ধু। এই সুবাদে সেন পরিবারের সঙ্গে আলী আকবর খানের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরী দেবীকে নজরুল ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। কবি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো কুমিল্লায় অতিবাহিত করেছিলেন। সেন পরিবারে চার-পাঁচ দিন থাকার পর আবার আলী আকবর খানের সঙ্গে পা বাড়ালেন দৌলতপুরের পথে।
দৌলতপুর নিভৃত এক অজপাড়া গ্রাম। বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এখানে আরেকটি ঘর ছিল, এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেওয়া হয়। এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন। এই বাড়িতে দু’টি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের এ জাতীয় কবি একটি আমগাছের তলায় দুপুরে শীতল পাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে কবি নজরুল খাঁ বাড়ির ও গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরকে নাচ, গান ও বাদ্য শেখাতেন। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আমগাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে।
গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এই আমগাছের পার্শ্ববর্তী পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও করতেন না।
পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আমগাছ আছে। এ আমগাছের তলায় এসে কবির মা (আলী আকবর খানের নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ তখন কবি ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। কবি শখ করে জাল কিংবা পলো দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কবি কুমিল্লায় থাকাকালে খাঁ বাড়িতে ১২টি কামরাঙ্গার গাছ ছিল, এখন আছে দু’টি। কবির শয়নকক্ষের সংলগ্ন স্থানে ছিল একটি প্রাচীন কামরাঙা গাছ, যা তার অনেক কবিতা-গান, হাসি-কান্না, মান-অভিমান ও মিলন-বিরহের নীরব সাক্ষী। কবি মাঝে মধ্যে, বিশেষ করে দুপুরে এই গাছটির শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। একটি কামরাঙা গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন- ‘কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে , ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের, তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে, হায় কে দেবে দাম।’
কবি ও আলী আকবর খাঁ যখন বিকেল বেলায় একসঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে শীতল পাটি বিছিয়ে কবিতা ও গান রচনা করতেন, রূপসি নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন এই গাছের নিচে। তখন কবি ও তার প্রিয়া চোখের ভাষায় ভাবময় করে তুলতেন তাদের জীবনের প্রেমকে। উত্তরকালের নার্গিসকে নিয়ে নজরুল অনেক অবিনাশী কবিতা রচনা করেছেন।
আরও পড়ুন: বোচাগঞ্জে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বর্ষবরণে আনন্দ শোভাযাত্রা
খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়ি। নার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সির মেয়ে। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেন। নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন। সেখানে নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছে। এটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। আটি নদীতে তিনি অনেক সাঁতার কেটেছেন। গোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোনো সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তো তার কবিতায় এসেছে - ‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে, গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে, আজো সে পথ চাহে সাঁঝে।’
দৌলতপুর থাকাকালে নজরুল যে-সব গান আর কবিতা লিখেছেন, এসব গান ও কবিতার বিষয় জুড়ে ছিল শুধুই নার্গিস।
নজরুল খানবাড়ির পুকুরপাড়ে বসে মনের আনন্দে বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলতেন। এক নিশুতি রাতে নজরুলের বাঁশের বাঁশির সুর শুনে ষোড়শী নার্গিসের মনে সৃষ্টি হয় রেখাপাত। হৃদয়ে জাগে দোলা, বুকে জাগে স্পন্দন। নার্গিস নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হন। কৃষ্ণের জাদুকর মন ভোলানো বাঁশির সুরে যেমনিভাবে রাধা আত্মহারা হয়েছিলেন, তেমনিভাবে নার্গিসও নজরুলের বাঁশির সুর-সুধায় হয়েছিলেন বিমোহিত। তখন নজরুলের প্রেম কাননে ফোটে নার্গিস ফুল। যৌবনে কবি নার্গিসের প্রেম-পরশে হয়েছিলেন আবিষ্ট। বাঁধন-হারা কবি বাঁধা পড়েন নার্গিসের মায়ার জালে।
প্রেমের পাঠ চুকিয়ে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালের ২০ জুন ধার্য করা হয় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের তারিখ। বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে ধুমধামের সঙ্গে।
নজরুল-নার্গিসের বিয়েতে লেখা হয় কাবিননামা। কবির মানস প্রেমিকা নার্গিসকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার মুহূর্তে বেজে ওঠে এক অশনি সংকেত। কাবিননামায় লেখা হয়েছিল বিয়ের পর নার্গিসকে নজরুল দৌলতপুর থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। নজরুলকে ‘ঘর জামাই’ হয়ে নাকি চিরদিনই থাকতে হবে দৌলতপুরে। কবি নজরুল ছিলেন পৌরুষদীপ্ত এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। ‘ঘর জামাই’ হয়ে শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরে থাকা কবির ব্যক্তিত্বে হানে চরম আঘাত। এতে কবি তার সহজাত প্রবৃত্তিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তবে সামাজিক মান-মর্যাদা সর্বোপরি প্রিয়তমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে বসলেন বিয়ের পিঁড়িতে। ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয় সম্পন্ন।
এরপর নজরুল-নার্গিসের মিলন হয়। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দু’জনার মাঝে শুরু হয় মধুর আলাপন। এই প্রেমময় শুভলগ্নে-শুভক্ষণে হঠাৎ আষাঢ়ের কালো মেঘের ধূপছায়া ফেলে দু’জনার হৃদয়াকাশে। দু’জনার মাঝে শুরু হয় বাক-বিতণ্ডা। সে উত্তপ্ত রেশ মুহূর্তের মধ্যে তিক্ততার চরমে পৌঁছে। আষাঢ়ের কালো মেঘ যেন কঠিন বজ্র-ঝড়ে রূপ নেয়।
‘ঘরজামাই’ হয়ে থাকার কথা শুনে কবি দুঃখে-ক্ষোভে, ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। নববধূ নার্গিসকে দৌলতপুর থেকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন কলকাতায়। কবি-বধূ নার্গিস বয়সে ষোড়শী অনূঢ়া। আর নজরুলও তখন সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখেছেন। ছিন্নমূল বাউন্ডুলে কবিকে বুঝে উঠতে পারেননি নবপরিণীতা নার্গিস। নাম-ঠিকানাবিহীন বাঁধন-হারা এক কবির সঙ্গে ঘর বাঁধলেও নার্গিস অজানা-অচেনা অনিশ্চিত পথে সে দিন পা বাড়াতে সাহস পাননি।
দুরন্ত-দুর্বার নজরুল। একরোখা মন তার। পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ার কাঁকর বিছানো রুদ্র কঠিন মাটির ছেলে, তেঁতে উঠলেন চৈত্রের খরার মতো। জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের মতো ফেটে পড়লেন রুদ্ররোষে। আর তখনই দ্রুত বাসরঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন নজরুল। বাসর ভাঙা রাতের দুঃস্বপ্নে চোখের জলে ভেসে যায় বুক।
নজরুল আর কখনও দৌলতপুরে ফিরে আসেননি। কবির স্মৃতি এখনও আঁকড়ে ধরে আছে দৌলতপুরবাসী। নজরুলকে ভুলতে পারেনি এ জনপদের মানুষ। দৌলতপুরে কবি নজরুলের চারটি স্মৃতিফলক রয়েছে। যেই ঘরে কবি নজরুল ও নার্গিসের বাসর সম্পন্ন হয়, সেটি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটচালা ছিল। বর্তমানে চারদিকে বেড়ার আর টিনের ছাউনিতে রূপান্তরিত হলেও আয়তনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। নজরুল ও নার্গিসের বাসরে ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক, বিছানা, দু’টি বালিশ, কম্বল ও কাঠের সিন্ধুকটি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
সরেজমিনে নার্গিসের বাড়িতে গেলে কথা হয় তার উত্তরসূরি বাবলু আলী খানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, নার্গিসের প্রেমেই নজরুল ইসলাম প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠেন। নার্গিস ও নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে এখানে সরকারিভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে এক সময় এগুলো হারিয়ে যাবে। তার দাবি, এখানে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হোক। যাতে করে নজরুল ইসলামের যে ভালো সময় দৌলতপুরে কাটিয়েছেন, তা মানুষ জানতে পারবে।
তবে শেষ পর্যন্ত নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলা। প্রমীলার ডাকনাম ছিল দুলি। তাদের এই বিয়ে প্রেম থেকে নয়, বরং পারিবারিক সম্মতিতে স্থির হয়। তবে জানা যায়, নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালে প্রমীলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রমীলার সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় ছিল। তার এই প্রেমের কথা তার ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। কলকাতার ৬ নং হাজী লেনে তাদের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।
কুমিল্লায় গোমতী নদীর আনন্দময় স্মৃতিকে মধুরতম করতে নজরুল লিখেছিলেন, ‘উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকাল যায়, ঘুম জড়াল গোমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়’ (চৈতী হাওয়া ছায়ানট)। প্রমীলাকে নিয়ে গোমতীর নদীর স্মৃতিও উঠে এসেছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম উঠিল কাঁদি অপরূপ ব্যথা, গন্ধ নাভি পদ্মমূলে।’ (পূজারীনি দোলনচাপাঁ) ।
নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালীন (১৯২১-২৩) ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন রানীর দিঘীর পশ্চিমপাড়ে কৃষ্ণ চূড়া গাছের নিচে বসে প্রতিদিন কলেজ পড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন, আড্ডা দিতেন বলেও জানা যায়। বর্তমানে স্থানটিতে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। এখানে বসে কবি নজরুল, ‘মাধবী লতা দোলে’সহ আরও অনেক গান ও প্রমীলার কাছে চিঠি লিখেছেন।
ধর্ম সাগরের পশ্চিমপাড়ে বসে নজরুল গান ও কবিতা লিখতেন, সেই স্থানে রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয় বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সঙ্গে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন, এখানেও রয়েছে নজরুল ফলক। শহরের বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরাতন ইউসুফ স্কুল। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের নিকটেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। এই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সঙ্গীত জলসায় অংশ নিয়েছেন। নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে।
ফলকে উল্লেখ করা হয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিসে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেক গান গেয়েছেন। টাউন হল ময়দানে অনেক সমাবেশ, অনেক জনসভায় অংশ নিয়েছেন কবি। শহরের মহেশাঙ্গন স্থানটিও নজরুল স্মৃতিবিজড়িত। ওই সময় স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। প্রতিদিন সভা-সমাবেশ লেগেই থাকতো মহেশাঙ্গনে। এখানে অনেক সমাবেশে ভক্তদের অনুরোধে গানে অংশ নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি। ‘আলো জ্বালা - আলো জ্বালা’ প্রভৃতি গান গেয়েছেন।
শহরের মুরাদপুর চৌমুহনীর কাছেই ইতিহাসখ্যাত জানু মিয়ার বাড়ি। জানে আলম চৌধরী ছিল নজরুলের সুহৃদ। এই বাড়িতে রক্ষিত ছিল নজরুলের ব্যবহৃত তবলা। বাড়িটি একতলা ছিল, এখন দ্বিতল। এই বাড়ির ফলকে লেখা আছে— ‘এই মুরাদপুর মৌলভি বাড়ির জানে আলম চৌধুরী (জানু মিয়া) ছিলেন একনিষ্ঠ সঙ্গীত সাধক। উপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা এই বৈঠকখানার গানের আসর জমিয়েছেন।’ তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, শচীন দেব বর্মণ ও কাজী নজরুল ইসলাম। শহরের ২য় মুরাদপুর মুরগি খামার অফিসের পেছনে মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মন বাহাদুরের রাজবাড়ীতে ১৯২২ সালে অনেক দিন নজরুল তার বন্ধু শচীন্দ্র দেব বর্মনের সঙ্গে বসে সংগীত চর্চা করতেন।
কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা নজরুল প্রেমী সাংবাদিক অশোক কুমার বড়ুয়া বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর কুমিল্লা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। নজরুল ইসলামের জীবনে ‘প্রথম প্রেম’ হয় কুমিল্লায়। কুমিল্লাতেই নজরুল ইসলামের দুই প্রিয়তমার বাড়ি।
কুমিল্লা শহরের সার্কিট হাউস রোডে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে চেতনায় নজরুল স্মারক ভাস্কর্য, নগরীর বাদুরতলায় রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিফলক। এছাড়া নগরীর রানীরকুটিরের পাশে রয়েছে কাজী নজরুল পরিষদ।
প্রতিনিধি/ এমইউ