images

সারাদেশ

জনবল সংকটে ধুঁকছে জিসিসি, নাগরিক জীবনে দুর্ভোগ চরমে

জেলা প্রতিনিধি

০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫১ এএম

গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি) আয়তনে দেশের বৃহত্তম। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনবল সংকট নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এ সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম।

মেয়রহীন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশল, সচিবসহ গুরুত্ব ৯ পদসহ অসংখ্য পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। একারণে অর্ধকোটির বেশি মানুষের সেবা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, শূন্যপদে জনবল পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। নিয়োগ বিধি অনুমোদন না হওয়ায় নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি সাবেক গাজীপুর পৌরসভা ও টঙ্গী পৌরসভা এলাকাসহ ৩২৯ দশমিক ৯০ বর্গমিটার আয়তন এলাকা নিয়ে গঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি)। আয়তনের দিক থেকে এটি বৃহত্তম। বর্তমানে নগরীতে বসবাস করে ৬০ লাখের বেশি মানুষ। প্রতিষ্ঠাকালে দুই পৌরসভার জনবল নিয়েই এর যাত্রা শুরু হয়। জনবল কাঠামো ও নিয়োগ বিধি না থাকায় পরে আর স্থায়ীভাবে জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে শুরু থেকেই মেয়র সংকট, জনবল সংকট নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জিসিসি।

অপরদিকে, করপোরেশন গঠনের ১০ বছর পর ২০২২ সালে জিসিসির জনবল কাঠানো অনুমোদন করা হয়। কিন্তু তারপরে গত ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধী জনবল নিয়োগ বিধিমালা অনুমোদন করা হয়নি। ফলে নতুন করে কোনো জনবল নিয়োগ/পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একারণে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলেও প্রায় ১২ বছরের অধিক কাল ধরে পৌরসভার জনবল দিয়েই চলছে সিটি করপোরেশনর সেবার কাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৬০ লাখ মানুষের সেবার জন্য নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু মেয়র বা যোগ্য নেতৃত্ব সংকট নয়, জনবল সংকটেও ধুকছে। এতে উন্নত ও কাঙ্ক্ষিত সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। একই সঙ্গে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাসহ নানা কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়ছে। শূন্য পদগুলোতে প্রেষণে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিলে নাগরিক সেবা বাড়বে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, জিসিসির সকল উন্নয়ন, সংষ্কার, রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে প্রকৌশল বিভাগ। সেই প্রকৌশল বিভাগে দীর্ঘদনি ধরে প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নেই। জিসিসির ৮টি অঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগে দুই জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, ৮ জন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পদে কর্মরত অধিকাংশ প্রকৌশলীরা বর্তমানে চলতি দায়িত্ব/অতিরিক্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও জিসিসির সচিব, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রোগ্রামার, ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ ৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এসব পদে কোনো কর্মকর্তা না থাকায় কাজকর্মে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

নাগরিকদের দাবি, মেয়র না থাকায় নেতৃত্ব শূন্যতায় ধুঁকছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি)। ক্রম: বিকাশমান শিল্প কারখানা সমৃদ্ধ গাজীপুর সিটি করপোরেশন কার্যত অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, জনবল সংকট। এসব কারণে ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানটি নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ সিটি করপোরেশনকে জনবান্ধব ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে রুপ দিতে হলে দ্রুত মূন্যপদে দক্ষ জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে গাজীপুর নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন বলেন, পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন শুধু নামেই হয়েছে। মহানগরীর কোথাও নাগরিক সুবিধার ছিটে ফোটা চিহ্ন দেখা যায় না। সিটি করপোরেশন হওয়ার জন্য যে সব নাগরিক সুবিধা থাকার দরকার, তার কিছুই এখানে নেই। মেয়র না থাকা, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা কর্মচারী না থাকায় এখানে পৌরসভা আমলের চেয়ে সেবার মান এক কানাকড়িও বাড়েনি। বরং বেড়েছে জন দুর্ভোগ আর হয়রানি।

তিনি আরও বলেন, গত এক যুগেও গাজীপুরে নাগরিক সেবা না বাড়ায় আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। গেল ৩ নির্বাচনে আমরা অনেক আশা নিয়ে মেয়র নির্বাচিত করেছিলাম। কিন্তু একজনও তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। উন্নত নাগরিক সেবা আমাদের দিবা স্বপ্ন। বারবার অভিভাবকহীন সিটি করপোরেশন স্থবির হয়ে পড়েছে। গতিশীলতা দেখছি না। অনিয়ম দুর্নীতি, স্বেচ্চাচারিতা, নেতৃত্ব, জনবল সংকট নগরীকে বাসের অযোগ্য করে তুলেছে।

তিনি আরও বলেন, সেবার জন্য নগর ভবনে গেলেই শোনা যায়, লোক নাই। যদি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ/পদায়ন করা না হয়, তাহলে এতবড় সিটি করপোরেশন গঠন করে নগরবাসীকে বাড়তি করের বোঝা ও হয়রানিতে ফেলার কি দরকার ছিল? আমরা দ্রুত শূন্যপদে পদায়ন ও নিয়োগ বিধি অনুমোদন করে নতুন লোক নিয়োগের দাবি জানাই।

গাজীপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক এ এন এম মুনীর হোসাইন মোল্লা বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠনের পর ১২ বছর হয়ে গেলেও বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। সর্বত্র অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সড়ক-মহাসড়কের পাশে আবর্জনার ভাগাড়, ভাঙাচুড়া রাস্তা-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক এমনকি গলি পথেও যানজট থাকে। অপ্রতুল ট্রাফিক ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। সামনে বর্ষাকাল। অনেক রাস্তায় সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। অনেক বাসা বাড়িতেও পানি চলে আসে। এসব নিয়ে কারো কোনো চিন্তা নেই। সিটি করপোরেশন কার্যত একটি স্থবির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেবার মান বাড়াতে শূন্য পদে পদায়ন, নতুন জনবল নিয়োগসহ যা প্রয়োজন সেই সব ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি।

 

জিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ খান (যুগ্ন সচিব) গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন শূন্য থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, সিটি করপোরেশন হলেও আমরা এখনো পৌরসভার জনবল দিয়েই কাজ চালাচ্ছি। আমাদের এখানে জনবল সংকট আছে। এ কারণে আমরা অনেক সময় নাগরিকদের সঠিকসময়ে সেবা দিতে পারছি না। শূন্যপদ পূরণ ও নতুন জনবল নিয়োগ হলে আমাদের সংকট কাটবে, সেবার মানও বাড়বে।

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জিসিসির প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিছু নাগরিক বান্ধব কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এগুলো সফলতা পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, জিসিসিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিকে নাগরিক বান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। গুরুত্বপূর্ণ শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। নতুন লোক নিয়োগ-পদোন্নতি প্রদানের জন্য নিয়োগ বিধিমালা প্রয়োজন। এটি এখনো অনুমোদন না হওয়ায় নিয়োগ-পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই এসবের সমাধান পাওয়া যাবে।

প্রতিনিধি/টিবি