images

সারাদেশ

পাহাড়ের প্রথম ম্রো নারী ডাক্তার সংচাং 

জেলা প্রতিনিধি

২২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম

আদমশুমারি অনুযায়ী ২০২২ সালে বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৫৩ হাজার। জেলার ১১টি পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে তারা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের বসবাস দুর্গম এলাকায়। যেখানে শিক্ষা-চাকরি থেকে বঞ্চিত অধিকাংশই মানুষ, যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, সরকারি আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া দুষ্কর। সেই দুর্গম এলাকার ম্রো জনগোষ্ঠীর পরিবার থেকে আসা প্রথম নারী ডাক্তার হলেন সংচাং ম্রো।

একটা সময় পাহাড়ের ম্রো আদিবাসীদের বলা হয়ে থাকতো সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। সময়ের পরিক্রমায় ম্রোদের মধ্যে এখন অনেকে অনেক দূর এগিয়েছেন। তেমনি একজন হচ্ছেন হলেন সংচাং ম্রো।

আরও পড়ুন: হাসিনার ফাঁসির দাবি ইবি শিক্ষার্থীদের

শুরুর পথটা এতটা সহজ ছিল না তার। মায়ের দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা ও বোনের চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার কারণে তার বাবা কাইংপ্রে ম্রো তার সন্তানদের মধ্যে একজনকে চিকিৎসক বানাবেন বলে মন স্থির করেন। শৈশবে বোনের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনায় দুঃখিত সংচাংও চাইতেন চিকিৎসক হতে।

এছাড়া তার বাবার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় মেয়েটি ম্রোদের মধ্যে প্রথম নারী ডাক্তার হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেন। সংচাং ম্রো রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ১৭-১৮ সেশনে ৪র্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে ডাক্তারি শেষ করে তিনি উক্ত মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করছেন।

ডা. সংচাং ম্রো’য়ের বাড়ি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাইয়া কারবারি পাড়ায়। তিনি কাইংপ্রে ম্রো ও তুমলেং ম্রোর মেয়ে।

আরও পড়ুন: পদত্যাগের দাবিতে যবিপ্রবি উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা দাহ

সংচাং ম্রো জানায়, শৈশবে বাবার কাছেই আমার প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। জুমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাবা আমাকে মাটিতে একেঁ বা কখনও কলাপাতায় একেঁ একটা একটা করে বর্ণ শিখাতেন। বাবা ভেবেছিল পড়াশোনা করলে হয়তো ওষুধের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবো, সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের পড়াশোনা করাতেন তিনি। কারণ আমাদের এক বোন চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছিলেন। তাছাড়া আমার মা দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ। গ্রামে স্কুল না থাকায় বাবা আমাকে গ্রাম থেকে অনেক দূরের লামা মিশন নামে হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেন। পরে এক বছর থাকার পর সেই হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেলে ফাদার লুপির পরিচালিত তৈদাং হোস্টেলে আমাকে ভর্তি করিয়ে নেন। সেই হোস্টেলে থাকা অবস্থায় আমি চম্পটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীকদম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করি ২০১২ সাল পর্যন্ত। এছাড়া পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে আমি টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাই।

সংচাং ম্রো আরও জানায়, আলীকদমে বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক না থাকা কারণে আমাকে যেতে হলো সেন্ট যোসেফস্ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অভাব-অনটনের মধ্যেও অনেক শিক্ষক, শিক্ষিকা ও সিস্টাররা আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এসএসসি পরীক্ষা পর আমি হলিক্রস কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হই। তখন টাকার অভাবে সেই সময়ে ভর্তি হতে পারিনি, খুব কেদেঁ ছিলাম। কিন্তু নমিতা সিস্টার আবার তার কলেজে আমাকে নিয়ে যান এবং কলেজ ফি আমাকে ফ্রি করে পড়াশুনা করার সুযোগ দেন। কলেজের অনেক শিক্ষক আমাকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন। মেরি মার্গারেট সিস্টার তো আমার হাতখরচও মাঝে মধ্যে দিয়ে দিতেন। আমার যখন এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয় তখনও টাকা না থাকায় আমি বাসায় যাইনি। কলেজে থাকাবস্থায় দুই ভাই-বোনকে পড়িয়েছি। সেই জমানো টাকা দিয়েই মেডিকেল ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বাবা বলেছিলেন যে বাসায় এসে একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে। কিন্তু আমি বাবাকে বলেছিলাম যতক্ষণ কোথাও আমার চান্স না হবে তত দিন আমি বাসায় ফিরবো না।

আমার সবচেয়ে খুশির দিন ছিল সে দিন, যে দিন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের রেজাল্ট পেয়েছি। কারণ সেখানে আমি চান্স পেয়েছিলাম। এর পরের দিনেই আমি বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। তখন প্রায় তিন বছর পর আমি বাসায় যাই।

মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমাকে আর টাকার জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা স্যার, সুবর্ণা ভুমি ফাউন্ডেশন, বিএসএসবির কর্মকর্তারা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেন। আমাদের সিনিয়র বড় বোন-ভাইরাও আমাকে বোন্স, বই-খাতা দিয়ে সাহায্য করতেন। তিনি আরও জানান, আমি চাই পাহাড়ের মানুষ যেন চিকিৎসার অভাবে আর মারা না যায়। পাহাড়ের এখনও সুচিকিৎসার যথেষ্ট অভাব।

এ বিষয়ে আলীকদম-নাইক্ষ্যংছড়ি ম্রো কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক থং প্রে ম্রো বলেন, সংচাং ম্রোদের মধ্যে প্রথম নারী ডাক্তার। তার এই কৃতিত্ব ম্রোদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

প্রতিনিধি/ এমইউ