images

সারাদেশ

ঢামেকের মর্গে লাশের স্তুপে পড়েছিল শিশু হোসাইনের মরদেহ

জেলা প্রতিনিধি

২৯ জুলাই ২০২৪, ০৪:৩২ পিএম

হোসাইন মিয়া। বয়স মাত্র ১০ বছর। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। অভাবের সংসার। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকার চিটাগাং রোড এলাকায় বাসে বাসে ফেরি করতো সে। গত ২০ জুলাই শনিবার বিকেল ৩টার দিকে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয় শিশু হোসাইন মিয়া। এরপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তার।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হোসাইন মিয়ার বাবা মানিক মিয়া সন্তানের খোঁজে বের হন। এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে দুই ঘণ্টা হেঁটে বাসায় এসে দেখেন, তার ছেলে এখনো বাসায় ফেরেনি। এরপর দুই মেয়েকে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে স্ত্রী মালেকাকে সাথে নিয়ে আবার খুঁজতে বের হন। রাত ৯টার দিকে কেউ একজন মোবাইল ফোনে আহত হোসাইনের ছবি দেখান মানিক ও মালেকা বেগমকে। সন্তানের ছবি দেখে চিনতে পারেন। এরপর তারা জানতে পারেন তাদের সন্তানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তখনও রাস্তায় গণ্ডগোল চলছিল। এরমধ্যে তারা একটি পিকআপ চালককে হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে কোনো রকম যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে একটি রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান।

সেখানে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। কোথাও না পেয়ে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারেন চিটাগাং রোড থেকে যারা আহত হয়ে আসছে তাদের চিকিৎসা চলছে। এরপর তারা রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছেলেকে দেখার জন্য বসে ছিলেন মা-বাবা। রাত ২টার পর একজন এসে মানিক মিয়াকে মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, এটি কি আপনার সন্তান? মানিক মিয়া ছবি দেখে হ্যাঁ বললে তিনি মানিক মিয়াকে মর্গে নিয়ে যান। মানিক মিয়া মর্গের ভেতর গিয়ে দেখেন লাশের স্তুপের ওপর তার ছেলের গুলিবিদ্ধ নিথর মরদেহ পড়ে আছে। সাথে সাথে মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের বুকফাঁটা চিৎকারে ভারী হয়ে উঠে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ।  

আরও পড়ুন

নতুন জামা কিনতে বের হয়ে গুলিতে পা হারালেন রাকিব

‘কার কাছে বিচার দিমু, গরিবের আবার বিচার আছে নাকি’

গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট হোসাইনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বরিশল গ্রামে। তার নানার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে। হোসাইন তার মা বাবার সাথে চিটাগাং রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। মানিক-মালেকা দম্পতির মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের দুই মেয়ে আছে।

শিশু হোসাইনের লাশ গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার বরিশল গ্রামে না নিতে পেরে ২২ জুলাই রাত ২টার দিকে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়। হোসাইনের নানার বাড়ি দেবিদ্বারের বেতরা গ্রামে মা মালেকা বেগম ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আর্তনাদ করছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিতে এসেও চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি। মায়ের আর্তনাদে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি গ্রামের লোকজন।

6565

কেঁদে কেঁদে মালেকা বলছিলেন, ‘ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে বলছিলাম। ছেলে বের হয়ে যায়। আমি বার বার ডেকে ঘরে আনার জন্য যাই, আর বলি বাবা রাস্তায় গোলাগুলি হচ্ছে, তুই বাসায় চলে আয়। ছেলে বলে মা আমি ছোট্ট, আমারে কে গুলি করবে? আমি গার্মেন্টসে কাজ করতাম। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলে বলে মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, আমি তোমার চিকিৎসার জন্য বাসে বাসে ফেরি করব। আমার ছেলে বাসে বাসে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট বেচে যা আয় করত তা পুরোটা আমার চিকিৎসার খরচ দিত।

আরও পড়ুন

বাবাকে আর ডাক্তার দেখানো হলো না মামুনের

এখনও কাঁদছে আসিফের মা, দিশেহারা বাবা

হোসাইনের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার সোনার মানিকের কী অপরাধ ছিল, তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? আমার ছেলেকে কেউ ফিরাই দাও। আল্লাহ অ’তুমি কেন আমার বুকের মানিককে কাইড়া নিলা।’

হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, আমার ছেলে শনিবার বিকেলে মারা গেছে। এই লাশ আনতে গিয়ে কত বিপদেই না পড়ছি। এই অফিসে যাও, হেই অফিসে যাও। থানায় গিয়া জিডি করো। কত স্বাক্ষর দিছি। এরপর সোমবার ছেলের লাশ পাইছি। এই লাশ লইয়া আইতে গিয়া আরও কত বিপদ পড়েছি। সোমবার রাত দুইটার দিকে দেবিদ্বার নানার বাড়িতে জানাজা ও দাফন হয়।

এ বিষয়ে দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ছোট্ট হোসাইনের নানার বাড়িতে আমি গিয়েছি। তাদের আর্তনাদ দেখে আমি নিজেও সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে নিহত হোসাইনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তার পরিবারকে আরও সহযোগিতা করা হবে।

প্রতিনিধি/জেবি