জেলা প্রতিনিধি
১৪ মে ২০২৪, ১১:১৭ এএম
ছোটবেলায় কেউ বাবাকে হারিয়েছেন, কেউ মাকে। আবার কেউ শিশুকালেই পরিচয় হারিয়ে হয়েছে পথশিশু। অনেকের অভাবের তাড়না ও নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকা হয়নি নিজ পরিবারে। কখনও কাছের স্বজনদের স্নেহের পরশ পাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি কারোরই। নেই প্রতিবেশি, নেই পরিচিত কেউ। এমনই ৬ বালক এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন পেয়েছেন জিপিএ-৫। সবার স্বপ্ন স্বনির্ভর হওয়ার। ফিরে পেতে চান পরিবারকে।
অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে উঠে আসা এই ছয় বালক একে অপরের বন্ধু। তারা হলেন- মো. সুমন রানা, মো. সুমন ইসলাম, কাজিম উদ্দীন, মো. সুজন আলী, রবিউল ইসলাম এবং মমিনুল ইসলাম।
জানা যায়, ছোট থেকে তারা বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে'। এবছর তারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের মতো স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরও ১৬০ জন মা-বাবাহীন অনাথ শিশু।
এসএসসি উত্তীর্ণ এই ৬ জনের মধ্যে সুমন রানা, কাজিম উদ্দীন ও মমিনুল পঞ্চগড় সদরের মাঘই পানিমাছ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং সুমন ইসলাম, সুজন আলী ও রবিউল পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমুল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।
সোমবার (১৩ মে) বিকেলে এই শিশু নগরীতে গিয়ে দেখা যায়, দু’পাশে দু’টি বড় বড় ভবন। মাঝে একটি বিশালাকার খেলার মাঠ। শিশুদের পদচারণায় মুখর মাঠটি। সেখানে কথা হয় সদ্য এসএসসি পাস করা এই ছয় জনের সঙ্গে।
জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন মো. সুমন রানা। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের মাদারিপাড়া গ্রামে বাড়ি তার। জন্মের পরপরই তার কৃষক বাবা হাসমত আলী মারা যান। শুরু হয় পরিবারে টানাপোড়েন। ৭ সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা খোদেজা বেওয়া। থাকতে হতো খেয়ে না খেয়ে। সন্তানদের পড়ালেখা ছিল কল্পনাতীত। সুমনের বয়স যখন ৭ বছর, তখন এক সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই মিশনে ঠাঁই হয় তার। এরপর থেকে শুরু হয় তার নতুন স্বপ্ন দেখা। প্রাথমিকেও ভালো ফলাফল ছিল তার। চিকিৎসক হতে চান সুমন, অসহায় মানুষের সেবা করতে চান তিনি।
জিপিএ-৪.৭১ পাওয়া সুমন ইসলাম জানান, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের চতুরাগছ গ্রামে তাদের বাড়ি। দিনমুজুর বাবার আয়ে ভালোই ছিল পরিবার। ২০১৬ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার মৃত্যুতে ছন্দপতন ঘটে সবকিছুর। এরপর পাথর শ্রমিকের কাজ শুরু করেন তার মা সপিরন বেগম। কিন্তু মায়ের আয়ে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে তার। পরে এক দুঃসম্পর্কের স্বজনের মাধ্যমে এখানে আসেন তিনি। বলেন, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাস করব- এটা ছিল স্বপ্নের মতো। পাস করেছি, এই অনুভূতি বোঝাতে পারব না। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।
জিপিএ-৪.৩৯ পেয়েছেন কাজিম উদ্দীন। তিনি বলেন, আমার জন্মস্থান গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চরমাদারিপাড়া গ্রামে। ২০১৫ সালে আমার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকেই মায়ের কাছে ছিলাম, কিন্তু মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে আমার পড়ালেখা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তবে আমার মা চাইতেন আমি পড়ালেখা করি। তাই এক সমাজকর্মীর মাধ্যমে আমাকে এখানে পাঠান। এখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের মাঘই পানিমাছ পুকুরি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এবছর এসএসসি পাশ করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরও ভালো করতে চাই। বলেন, এখানে থাকাকালীন ২০১৮ সালে আমার মা মারা যান। আজকে মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন।
মো. সুজন আলীর রেজাল্ট জিপিএ-৪.২৫। নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলার ডাক্তারবাড়ি গ্রামে। ছোটকালে মা লাকী বেগমের মৃত্যুর পর তার বাবা খোরশেদ আলী আবার বিয়ে করেন। সে থেকেই পরিবারে অবহেলিত হয়ে পড়েন সুজন এবং তার বড় ভাই শাহিন। সেসময় তার এক ফুপু ঢাকায় থাকতেন। তার মাধ্যমে কাজ যোগদেন এক গ্যারেজে। সেখানে মালিকের মার খেয়ে পালিয়ে যান সদরঘাটে। সেখান থেকে এক সমাজকর্মীর মাধ্যমে ২০১৩ সালে এই মিশনে আসেন সুজন। সুজন বলেন, গত ১১ বছরে কখনও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, আমি কোথায় আছি তারা জানে না। খুব মন চায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে, দেখা করতে। পড়ালেখা শেষে গ্রামে ফেরার ইচ্ছে আছে।
জিপিএ-৪.৩২ পেয়ে উত্তীর্ণ রবিউলের গল্পটাও করুন। বাবা পারভেজ ছিলেন ট্রাকের হেল্পার। পরিবারসহ ঢাকায় থাকতে শুরু করেন তারা। হঠাৎ করেই সেখান থেকে হারিয়ে যায় শিশু রবিউল, আর খুঁজে পাননি পরিবারকে। অন্য পথশিশুদের সঙ্গে কোনো এক রেল স্টেশনে পৌঁছলে সেখান থেকে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এখানে আসেন তিনি। তখন থেকেই রবিউলের সবকিছু এই শিশু নগরীই। রবিউল বলেন, দেশের বাড়ি নোয়াখালী জেলায় এতটুকুই মনে আছে। বাবা-মাকে দেখলে চিনতে পারব। কিন্তু তারা কোথায় আছে, কেমন আছে তাতো জানি না। বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে।
জিপিএ-৪.৪৪ পাওয়া মমিনুল ইসলামও বাবাকে হারিয়েছেন শৈশবে। কুড়িগ্রামের চিলমারিতে তাদের বাড়ি। অভাবের তাড়নায় মা রোকেয়া বেগম তাকে তুলে দিয়েছেন এই মিশনে। সবে এসএসসি পাশ করেছেন মমিনুল। পড়ালেখা শেষ করে কিছু একটা করতে চান, দুঃখিনী মায়ের মুখে হাসি ফোঁটতে চান।
আরও পড়ুন
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সী ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ৬ জনের মতো প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকেই রয়েছে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া, জানে না নিজের পরিচয়। আবার কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। এমনও আছে কারও বাবা-মা দু’জনই নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছে তারা। সময়মত পড়ালেখা, বাকী সময় খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে পার করে তারা।
শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, শিশুদেরকে এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। সদ্য এসএসসি পাস করা ৬ জনও এখান থেকেই প্রাথমিক শেষ করেছিল। শিশুদের যাবতীয় খরচবহনসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে আহছানিয়া মিশন।
শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হবার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে শিখে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে।
তিনি বলেন, আহছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য হলো এই শিশুদের ১৮ বছর পূর্ণ হলে কর্মমূখী শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সদ্য এসএসসি পাসদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে আহছানিয়া মিশন।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দীপক কুমার রায় বলেন, অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ৬ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একজন জিপিএ-৫ সহ সবার ভালো ফলাফল এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে।
আরও পড়ুন
দীপক কুমার রায় বলেন, এই শিশু নগরী গত এক দশক ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় চলছিল। তবে গত আড়াই বছর ধরে আহছানিয়া মিশনের নিজস্ব অর্থায়নে চালাতে হচ্ছে। এতে নানান সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি বা দাতা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত না বাড়ালে হিমশিম খেতে হবে। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে শিশুদের সব স্বপ্ন। এই মহতী কার্যক্রম ধরে রাখতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
প্রতিনিধি/এসএস