জেলা প্রতিনিধি
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:২৫ পিএম
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ধাপ এলাকায় নদীর পাড় ঘেঁষে সরু একটি রাস্তা। সেখানে দাঁড়ালে একপাশে নদীর স্রোতের হু হু শব্দ, অপর পাশে দেখা মেলে গাড়লের খামার। খামার থেকে গাড়লের ব্যা ব্যা ডাক আর ছুটাছুটির শব্দে মুখরিত এ গ্রাম। এখানে ‘যমুনা গাড়ল’ নামের একটি খামার গড়ে তুলেছেন নাজমুল ছাদাত।
তিনি পেশায় একজন কৃষি কর্মকর্তা। চাকরির পাশাপাশি নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বলা যায় সখের বসে খামারি হয়েছেন তিনি।
প্রায় চার বছর আগে ৪০ শতক জায়গার ওপর গাড়লের খামার গড়ে তোলেন তিনি। খামারে প্রথমে মেহেরপুর, টাঙ্গাইল জেলা থেকে গাড়ল সংগ্রহ করেন। গাড়ল ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। পালন করাও খুব সহজ। ভেড়ার জাত গড়াল পশু হিসেবে কোরবানিও দেওয়া যায়।
বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় অনেকে গাড়ল পালন করে উদ্যোক্তা হচ্ছেন এবং বেশ লাভের মুখ দেখছেন।
চাকরির পেছনে না ছুটে শিক্ষিত বেকার তরুণরা যদি গাড়ল পালনে এগিয়ে আসেন তাহলে অল্প দিনেই সফলতার দেখা মিলবে বলে আশা করেন নাজমুল ছাদাত। গাড়ল ভেড়ার জাত। এরা নিরীহ ও বোকা। দেখতে ভেড়ার মতো হলেও সুন্দর। অনেকটা দুম্বার মতো।
গাড়ল পালন খুবই লাভজনক। এতে খরচ কম, লাভ হয় বেশি। দেশে গাড়ল পালনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বেশি হওয়ায় এর মাংসের চাহিদা ব্যাপক। ভারতের নাগপুর অঞ্চলের ছোট নাগপুরি জাতের ভেড়ার সঙ্গে আমাদের দেশি ভেড়ার ক্রসব্রিড হলো গাড়ল। এগুলো ভেড়ার চেয়ে আকৃতিতে বড় এবং লেজ লম্বা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় গত চার বছরে গড়ালের ৩ থেকে ৪টি খামার গড়ে উঠেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক গৃহস্থ ও কৃষক গড়াল পালন করছেন।ি
আরো পড়ুন: হাঁস পালন করেই শিল্পীর ঘরে এখন সুখের ছোঁয়া
নাজমুল ছাদাত বলেন, গড়াল সাধারণত কাঁচা ঘাস, গাছের পাতা, বিচালি, ভূষি, খৈলসহ সব ধরনের খাবার খেয়ে থাকে। ভেড়ার মতো গড়ালও একে অপরের অনুসরণ করে চলে। এ জন্য গড়াল পালন করা অনেক সহজ। তবে পুরুষ গড়াল শান্তশিষ্ট দেখা গেলেও রাগি প্রকৃতির। সুযোগ পেলে মাথা দিয়ে আঘাত করে।
তিনি আরও জানান, যমুনার চরে তাদের জমি রয়েছে। আর কিছু জমি চুক্তিতে নিয়েছেন।
গড়ালের জন্য জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করা হয়। খাওয়ানোর জন্য প্রতিদিন সকাল ৯ টার দিকে গড়ালগুলোকে নৌকাযোগে চরের জমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার নিয়ে আসা হয় সন্ধ্যার আগে। শীতকালে এদের গ্রোথ কম হয়ে থাকে এবং গরমকালে বৃদ্ধি পায় বলেও জানান তিনি।
নাজমুল সাদাত শাওন বলেন, প্রথমে ৬৫টি গড়াল নিয়ে খামার করলেও এখন ১৫০টি গাড়াল রয়েছে তার খামারে। গড়ালের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সম্প্রতি কিছু গড়াল বিক্রি করেছেন। গড়াল সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। এদের রোগব্যাধি অনেক কম। এ জন্য পালন সহজ।
প্রতি ৭ মাস পর পর গড়াল বাচ্চা দেয়। প্রসবকালে ২টি পর্যন্ত বাচ্চা হয়। ৪ থেকে ৫ মাসের একটি গড়ালের বাচ্চার দাম ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। মাদি গড়াল বিক্রি হয় প্রতিটি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকায়। গর্ভবতী গড়াল বিক্রি হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। পাঠা গড়াল বিক্রি হয় প্রতিটি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। গড়ালের মাংস ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এর মাংস সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদা বেশি। পূর্ণ বয়স্ক গড়ালের ওজন ৫৫ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়। চাকরি না খুঁজে গড়াল খামার করেই স্বাবলম্বী হতে পারেন অনেকেই। গড়াল পালনে বাড়তি খাবারের প্রয়োজন নেই। আগামীতে এক থেকে দেড় হাজারের মতো গড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, দিন দিন গড়াল পালনে বাড়ছে কর্মসংস্থান। তার খামারে ৪ থেকে ৫ জন কাজে নিয়োজিত। তিনি এলাকার অনেক বেকার যুবককে গড়াল পালনে সহযোগিতা করেছেন। খামার পরিচ্ছন্নতা কাজে যুক্ত বৃদ্ধ জবেদ আলী(৭০)।
আরো পড়ুন: বিক্রমপুরের ঘোষবাড়ির মাঠার খ্যাতি দেশজুড়ে
তিনি বলেন, গড়ালের খামারে তিনি ৪ বছর কাজ করছেন। তিনি গড়াল গুলোকে চরে নিয়ে যান প্রতিদিন, সবুজ ঘাস খাওয়াতে। এই চর এলাকায় খামার টি গড়ে ওঠায় চরের ২/১ জন মানুষের কর্মের পথ হয়েছে। এ থেকে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার কোনোমতে চলে যায় তার।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বগুড়া ধুনট উপজেলা থেকে সিয়াম নামের একজন ক্রেতা এসেছেন গড়াল কিনতে। সিয়াম বলেন তিনি শুনেছেন গড়াল খামারে খুব লাভবান হন খামারিরা। খরচ কম হয় এটি পালন করতে।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি গড়ালের খামার করবেন। সে কারনেই তিনি খামার পরিদর্শন এবং কিনতে এসেছেন।
পৌর এলাকার সেখপাড়ার সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারিয়াকান্দি এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে যারা গড়াল পালন করছেন তিনি তাদের একজন। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তবে তার দীর্ঘদিনের শখ ছিল গড়াল পালনের। তাই যমুনা গড়াল খামার থেকে তিনি ৫টি গড়াল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন। এখন তার খামারে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গড়াল রয়েছে। বছর না ঘুরতেই তিনি দ্বিগুন টাকার সম্ভাবনা দেখছেন।
তিনি বলেন, পড়াশুনা শেষ করার পর চাকরি না খুজে অনেকেই নিজ উদ্যোগেই এলাকায় গড়াল খামার করছেন। প্রতিটি গড়াল ১৪ মাসে দুটি করে বাচ্চা দেয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আয় হয় প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকা। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ চারণভূমি থাকায় মাঠ থেকেই খাদ্য পাওয়া যায়। ফলে গড়ালের খামার করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। তিনি স’মিলের জন্য কেনা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করেও গড়ালগুলোকে খাওয়ান। সে হিসেবে গড়ালগুলোকে খাওয়ানোর জন্য বাড়তি কিছু কিনতে হয় না তার।
আরো পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প, শিল্পীদের মানবেতর জীবনযাপন
বগুড়া জেলায় বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা ১ লাখ ৬২ হাজার। এর মধ্যেই গড়ালও আছে। ভেড়ার মাংসের চেয়ে অনেক বেশি উপাদান মেলে গড়ালের মাংসে। যা মানব শরীরের জন্য বড় ভূমিকা রাখে। গড়ালের মাংসে জিঙ্ক, আয়রণ, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সেলিনিয়াম ভিটামিন-বিসহ কয়েক প্রকারের খনিজ রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ও শরীরে ইমিউনিটি বাড়াতে বিদেশে গড়ালের মাংসের পরিমিত খাবার গুরুত্ব পেয়েছে।

গড়াল পালন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। পুষ্টির উৎস হিসাবে গড়ালের গুরুত্ব গরু-ছাগলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গড়ালের মাংসে কোলেস্টেরল অনেক কম। সব বয়সী মানুষ এর মাংস খেতে পারে। এ কারণে গড়ালের খামারে প্রতি অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন ও দিন দিন এর প্রসার বাড়ছে। গড়াল পালনে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
প্রতিনিধি/একেবি