রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প, শিল্পীদের মানবেতর জীবনযাপন

জনি সরকার, জয়পুরহাট
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৭ এএম

শেয়ার করুন:

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প, শিল্পীদের মানবেতর জীবনযাপন

মৃৎশিল্প বাংলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শিল্পটি। মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও শিল্পীর মনের মাধুরি মিশিয়ে হাতের নিপুন ছোঁয়ায় ফুঁটে উঠে বাহারি নকশা। এই বাহারি নকশার কারণে আদিকাল থেকে দেশে এর চাহিদা ব্যাপক।

অনেকেই বংশগত পরম্পরায় দীর্ঘদিন এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় নিমিষেই তৈরি হয় সুন্দর সব মাটির জিনিসপত্র। দৃষ্টি নন্দন ফুলদানি, বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল, সরা, মটকা, সুরাই, পেয়ালা, পশু-পাখি, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই শিল্পীরা।


বিজ্ঞাপন


তবে কালের বিবর্তন ও প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এই শিল্পীরা এই শিল্পকে ধরে রাখতে পারছে না। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পকর্ম।

মৃৎশিল্পের প্রাচীন এক জনপদ জয়পুরহাট। এই জেলার পাঁচটি উপজেলায় কম-বেশি কুমার পাড়া রয়েছে। তারমধ্যে সদর উপজেলার পাল পাড়া, কালাই উপজেলার পালপাড়া, পাঁচবিবি উপজেলার পালপাড়া উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে কয়েক’শ বছর ধরে তাদের বসতি। কালের বিবর্তনে চাহিদা কমে গেছে এ শিল্পের। তাই বাঁচার তাগিদে অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ধরে রাখলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা জর্জরিত। এসব শিল্পীদের সহযোগিতা করার কেউ নেই। নেই কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

সরেজমিনে জয়পুরহাট সদরের পালপাড়ায় দেখা যায়, মৃৎ শিল্পীরা মাটি দিয়ে তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, হাঁড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কিন্তু তাদের গ্রামে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়ায় লাগেনি। পুরোনো ঘর, ভেতরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। ছোট টিনের ঘরবাড়ি। দুই একটি দেওয়াল ঘেরা। প্রতিটি বাড়িতে ছোট ছোট মেশিনে পা চালিয়ে মাটি কাটছেন অনেকে।


বিজ্ঞাপন


কথা হয় মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে। তারা জানান, নতুন প্রজন্ম যারা আছেন ও যারা আসছেন তারা অনেকেই এই শিল্প সম্পর্কে জানেন না ও জানবেন না। তাদের এই শিল্পের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন।

সদর উপজেলার পালপাড়ার বিপ্লব পাল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বাপ-দাদাকে এ কাজ করতে দেখেছি। এ ব্যবসার মাধ্যমেই সংসার চলতো। কিন্তু এখন সংসার আর চলে না। কোনো রকমভাবে দিন চলে যায়। মাটি কিনতে হয়, বালি কিনতে হয়, খড় কিনতে হয়, আগের দিনে এইসব উপকরণের দাম কম ছিল এখন অনেক বেশি দাম। এখন বেশির ভাগ সময় দইয়ের পাতিলই তৈরি করে চলি। বাজারে জিনিস পত্রের দাম বেশি হওয়ার এখন সংসার চালানোই অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।

একই গ্রামের নিপেন পাল ঢাকা মেইলকে বলেন, চৈত্রের শুরুতে কাজের খুব ব্যস্ততা থাকে আমাদের। বাকি সময়ে টিলেঢালা। তবে আগে যেমন হাতি, ঘোড়াসহ নানা পুতুল, বাহারি জিনিসপত্র বানাতাম, এখন তা বানানো হয় না। খরচ বেশি, বেচাবিক্রিও নেই। তাই এখন আমরা শুধু দইয়ের পাতিলই বেশি তৈরি করি। মাঝে মধ্যে কোনো অর্ডার পেলে অন্য জিনিসপত্র তৈরি করি।

এইসব কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা অন্য কাজ করতে পাারি না। অন্য কোনো কাজ করতে গেলে টাকা পয়সা লাগবে। সরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতাও পাই না।

মৃৎশিল্পী জয়ন্তী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বাবার বাড়িতেও এই মাটির কাজই করে। শ্বশুর বাড়িতে এসেও এই কাজই করছি। আগে বেচাকেনা বেশি হতো, এখন আর হয় না। আগে আমি নিজেই হাঁটে-বাজারে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতাম। এখন আর চাহিদা না থাকায় যাওয়া হয় না। এখন বাড়িতেই দইয়ের হাঁড়ি তৈরি করি। এখান থেকেই নিয়ে যায়। কোনো রকমভাবে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে দিন চলে যায়।

জয়পুরহাট বিসিকের উপ-ব্যাবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই মৃৎ শিল্পের কাজ চলে আসছে। আগের দিনে লোকজন সবাই মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করতো। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় এ শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই সরকারি সুযোগ সুবিধাগুলো নিতে পারেন। তারা চাইলে আধুনিক চাহিদাসম্পন্ন জিনিস তৈরি করতে সরকারি প্রশিক্ষণও নিতে পারেন।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর