মোস্তফা ইমরুল কায়েস
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ পিএম
ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক হোসাইন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চিফ অব প্লানিং অ্যান্ড শিডিউল অফিসার হিসেবে কর্মরত। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে এবং সেগুলো তদন্ত করে প্রমাণও মিলেছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন এই কর্মকর্তা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠভাজন হিসেবে পরিচিত। আর এই পরিচয়েই তিনি করে গেছেন নানা অপকর্ম।
বিদেশি পাইলটদের সংগঠনে এক্সিকিউটিভ পদে থেকেও বিমানের পরিচালনা পদে দায়িত্ব পালন করছেন ইশতিয়াক। সেটির বৈধতা দিতে বিমানের অপারেশন ম্যানুয়াল পর্যন্ত মুছে দিয়েছেন তিনি। বিমানে ছেলেকে ক্যাডেট পাইলট হিসেবে ঢোকানোর জন্য নিয়ম পরিবর্তন করেছেন। নিয়োগ ছাড়াই স্ত্রীকে বিমানের ক্যাপ্টেন পদে সরাসরি ঢোকানোর চেষ্টা, ব্যর্থ হয়ে বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মেরে ফেলার হুমকি, লন্ডনে এক পাইলটের মেয়ের বিয়েতে সরকারি খরচে গিয়ে পাঁচ রাত পরিবারসহ কাটানো এবং সিমুলেটেড ট্রেনিংয়ে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে পরে বিমানের কাছ থেকে এক রুমে থেকে দুই রুমের ভাড়া আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তদন্তে এসব ঘটনায় প্রমাণ মিললেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিমানের ভেতর ও বাহিরে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। যারা বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে ছিলেন তাদের সরিয়ে স্বচ্ছ ও কর্মঠ কর্মকর্তাদের সামনে আনা হচ্ছে। কিন্তু এখনো সরানো হয়নি এই ইশতিয়াককে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তার খুঁটির জোর কোথায়?
ইশতিয়াককে বিমানে সবাই ‘শেখ রেহানার কাছের মানুষ’ হিসেবে চেনেন। তিনি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। তার ভয়ে গত ১৫ বছর তটস্থ ছিলেন পাইলট থেকে শুরু করে বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কেউ কিছু বললেই বলতেন, আপা (রেহানা) আমার সব কিছু দেখভাল করেন। শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাকে নিয়ম ভেঙে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিমানের চিফ অব প্লানিং অ্যান্ড শিডিউল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে
বিমানে এ সংক্রান্ত যে ধারা আছে সেটিও অপারেশন ম্যানুয়াল থেকে মুছে দেন এই কর্মকর্তা। আর এটি করেছেন বিমানের আরেক পাইলট তানভীরকে দিয়ে। এখন আর সেই ম্যানুয়াল খুঁজে পাওয়া যায় না বিমানের সাইটে।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানের অপারেশন ম্যানুয়ালের সেকশন-০.৫ এর ৫.০.৯ ধারায় বলা ছিল-কোনো অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সেই সংগঠনে দায়িত্ব পালনকালে এক বছর বিমানের কোনো ম্যানেজমেন্ট পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু সেই ধারাটি তিনি নিয়োগ পাওয়ার পরই মুছে ফেলেন।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহেদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কেউ কোনো সংগঠনের নির্বাহী পদে থাকলে তিনি বিমানের পরিচালনা পদে থাকতে পারবেন না। আর যদি থাকেন সেটি হবে নিয়মের ব্যত্যয়। এই বিষয়ে যে ধারা রয়েছে সেটিও কেউ মুছে ফেলতে পারে না।’
বাংলাদেশ বিমানের অপারেশন ম্যানুয়েলে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনো অ্যাসোসিয়েশনের কোনো নির্বাহী বিমানের নির্বাহী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। তিনি আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব এয়ারলাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএএলপিএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে থাকা অবস্থায় বিমানের নতুন শিডিউল অফিসার হিসাবে যোগ দেন। পরে চাকরিতে প্রবেশে করে সেই ম্যানুয়ালে থাকা ধারাটি তারই বন্ধু আইটি অফিসারকে নিয়ে মুছে দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মুছে দেওয়া কপির ছবি ঢাকা মেইলের কাছে এসেছে।
বিমানের জনসংযোগ শাখার মহাব্যস্থাপক বোসরা ইসলামের পক্ষ থেকে পাঠানো বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে, বাপার মতোই পাইলটদের সংগঠন ইফালপা একটি সংগঠন। ফলে ইশতিয়াক সেই সংগঠনের দায়িত্ব পালনকালে বিমানের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে কোনো সমস্যা বা বাধা ছিল না। ফলে তার চিফ অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিং পদে থাকাকালীন IFALPA'র মতো Organization এ কাজ করা কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় নয়। কাজেই এ ব্যাপারে অপারেশন্স ম্যানুয়াল পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। সম্প্রতি CAAB, IOSA'র দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য বিমান সংস্থার মতো বিমানও অপারেশন ম্যানুয়ালে আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে CAAB নতুন অপারেশন ম্যানুয়ালের অনুমোদন দিয়েছে।
স্ত্রীকে অবৈধভাবে ক্যাপ্টেন বানানোর চেষ্টা!
বিমান সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিমানের পাইলট সংকট কাটাতে করোনাপরবর্তী সময়ে বেকার ও বসে থাকা (ইনটেক) পাইলটদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। তাদের সবাইকে এ সংক্রান্ত একটি মেইলও করা হয়। মেইল পেয়ে অনেকেই সাড়াও দেন। এর মধ্যে ছিলেন ইশতিয়াকের স্ত্রী সাহানাও। তাকে সরাসরি বিমানের ৭৮৭ বোয়িং বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিমানের বোর্ডে তার ফাইল তোলেন। সেই সময় দায়িত্বে থাকা বিমান বোর্ডের ডিজিএম রাসেদ সেটির বিষয়ে আপত্তি তোলেন এবং তিনি বোর্ডকে জানান এটি অনিয়ম। সবধরনের নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে ইশতিয়াক তার স্ত্রীকে ৭৮৭ বোয়িং বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োগে চাপ দেন। এরপর সেই মিটিং শেষ হওয়া মাত্র ইশতিয়াক তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেন। হুমকি পেয়ে ডিজিএম রাসেদ থানায় একটি জিডিও করেন। সেই সময়কার এমডি শফিউল আজিম বরাবরে বিচার চেয়ে অভিযোগ করলেও কোনো বিচার পাননি ভুক্তভোগী। অভিযোগটি এখনো বিমানেই পড়ে আছে বলে জানা গেছে।
তার স্ত্রীর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইলট সাহানা ২০০৪ সালে সিলেটে একটি এয়ারক্রাফট ক্রাশ ঘটিয়েছিলেন। পরে সেই ঘটনায় বিমানের অনেক টাকা ক্ষতি হয়। সেই সাহানাকেই আবারও বিমানে নিয়মের বাইরে ক্যাপ্টেন করতে চেষ্টা চালান ইশতিয়াক।
ছেলেকে পাইলট বানাতে নিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন!
ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তার ছেলেকে ক্যাডেট পাইলট হিসেবে বিমানে ঢোকাতে যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে পরিবর্তন এনেছেন। পরে তড়িঘড়ি করে তা প্রকাশও করেন। এখনো সেই প্রক্রিয়া চলছে।
নিয়ম হলো- ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে আবেদন করতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতায় এইচসিতে বিজ্ঞান, অংক ও পদার্থ বিষয় থাকা, জিপিএ-৩ অথবা জিসিএস-এ লেভেল থাকা বাঞ্চনীয়। বিমানের অপারেশন ম্যানুয়ালে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম ছিল ২০২১ সালের ‘১৪ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ২০২৩ সালে যোগদানের পর সেই নিয়োগও বদলে ফেলেন। শুধু তার ছেলেকে নিয়োগ দিতেই এই পরিবর্তন আনেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহেদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগের নিয়ম ফেলে এই পরিবর্তন করা হয়েছে শুধু কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। এটি তারা (বিমান) করতে পারেন না। আন্তর্জাতিক নিয়মের বাইরে পাইলট নিয়োগের সুযোগ নেই। এভিয়েশনে আন্তর্জাতিক রুল অবশ্যই ফলো করতে হবে।’
এছাড়াও ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে দুবাই থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে এনে ঢাকায় নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এভাবে এই পাইলট তার বাড়ির কাজ সম্পন্ন করেন বলে জানা গেছে।
ইশতিয়াকের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি তার বাবার পরিচয়ে কাডেট পাইলট হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর চারবার সিনিয়রিটি পরিবর্তন করা হয়। মূলত তাকে প্রথম অবস্থানে দেখাতেই তখন এসব করা হয়েছিল। সবকিছু হয়েছিল তার বাবা মনোয়ারের কারণে। এই মনোয়ারের সঙ্গে থাকা বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি গত কয়েক বছর বিমানের বলাকা ভবনে পেস্টিং করে সাঁটানো ছিল।
এবিষয়ে বিমান বলছে, ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে হঠাৎ করে কোনো নিয়ম পরিবর্তন করা হয়নি। যা হয়েছে সবার অনুমতি ও অনুমোদন সাপেক্ষেই হয়েছে।
বিয়ে খেতে সরকারি খরচে পরিবারসহ লন্ডনে ৫ রাত!
বিমান সূত্র জানিয়েছে, জয়নাল নামে এক ক্যাপ্টেনের মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে ২০২৩ সালে লন্ডনে গিয়েছিলেন ইশতিয়াক। এজন্য তিনি নিজের মতো করে ফ্লাইট শিডিউল সাজিয়ে নিয়েছিলেন। পরে সেখানে তার স্ত্রী ও সন্ত্রানদের নিয়ে পরিবারসহ একটি অভিজাত হোটেলে পাঁচ রাত কাটান। এ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ সরকারিভাবে দেখান ইশতিয়াক। তবে বিষয়টি নিয়ে বিমান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হলে সেটির প্রমাণ মেলে। যদিও এ বিষয়ে ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে বিমান কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
এ বিষয়ে বিমানের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেই সময় পাইলট সংকট ছিল। তার যাওয়ার কথা না থাকলেও তিনি ২০২৩ সালের ১৭ থেকে ২০ ডিসেম্বর লন্ডনের ফ্লাইটটি পরিচালনা করতে বাধ্য হন এবং সেখানে যান। আর ডিউটিরত অবস্থায় সেখানে পরিবারসহ থাকা, বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াটাকে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা মনে করছে না বিমান সংশ্লিষ্টরা।
শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠভাজন বলেই এত দাপট!
বিমানের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গেল ১৫ বছর ইশতিয়াক বিমানে একচেটিয়া আধিপত্য খাঁটিয়েছেন শুধু শেখ রেহানার কাছের মানুষ পরিচয় দিয়ে। বিমানের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, লন্ডনে শেখ রেহানার বন্ধু সাঈদ নাজমুল হাসান নসরুর মাধ্যমে পরিচয় হয় ইশতিয়াকের। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইচ্ছেমতো ফ্লাইট শিডিউল করে পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, মনোপুত পাইলট ও ক্রুদের দায়িত্ব দেওয়া, ভিভিআইপি ফ্লাইটে দায়িত্ব নিয়ে বিদেশ ঘোরার মতো কাজ করে তিনি বিমানের টাকা খরচ করেছেন। এসব সবাই জানত, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলত না। সবাই জানত তার পেছনে শেখ রেহানার অদৃশ্য সমর্থন রয়েছে। ফলে তিনি অনিয়মকে নিয়ম বানাতে পারতেন।
এত সব অভিযোগ থাকার পরও আওয়ামী লীগ সরকার একমাত্র শেখ রেহানার আস্থাভাজন হওয়ায় পাইলট ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি সেই সরকার পতনের পরও তিনি বহাল তবিয়তে। সূত্র জানিয়েছে, ইশতিয়াক এখন নিজেকে রক্ষার জন্য নানা কৌশল আঁটছেন।
তবে বিমান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ইশতিয়াক কখনোই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার বোনের আস্থাভাজন এবং সুবিধাভোগী একজন পাইলট ছিলেন না। তার সার্ভিস রেকর্ড অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন বলেও দাবি করেছে বিমান।
এবিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য কয়েক দিন কল ও মেসেজ করেও বিমানের এমডি ও সিইও সাফিকুর রহমানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। পরে বিমানের জনসংযোগ শাখার মহাব্যস্থাপক বুসরা ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইশতিয়াকের ওঠা অভিযোগের জবাব দেন।
এ বিষয়ে পাইলট ইশতিয়াক হোসাইনের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে হোয়াটসআপ কলে বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। যতক্ষণ না আমাকে বিমান অনুমতি দেবে।
এমআইকে/জেবি