প্রায় দুই কোটি মানুষের ভারে এমনিতেই বিপর্যস্ত মেগা সিটি ঢাকা। এর মধ্যে শীতকাল এলে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ে বায়ু দূষণ। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও শীত না আসতেই সারা বিশ্বে দূষণে শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী। সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি বায়ু দূষণে ভুগছে এই নগরীর মানুষ। সঙ্গে শব্দ দূষণের উৎপাত তো রয়েছেই। কোনোভাবেই এই দুই দূষণের ভয়াবহ কবল থেকে মুক্তি মিলছে না রাজধানীবাসীর।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বায়ু ও শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা শুরু থেকেই চালিয়ে আসছে। তবে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না দূষণ। এই অবস্থায় নড়েচড়ে বসেছে সরকার। নেওয়া হয়েছে দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ। তবে এসব উদ্যোগে কতটা সুফল মিলছে সেটা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বায়ু ও শব্দ দূষণ
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) সরকারি সব প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ২৫২ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম স্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। এবার শীতের শুরুতেই টানা কয়েক দিন বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সকালেও ঢাকার বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার বায়ুদূষণের তালিকায় গত কয়েক দিন ধরেই শীর্ষ তালিকায় থাকছে ঢাকা।
বিজ্ঞাপন
বায়ুদূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষণা অনুযায়ী, শীতকালে বা শুষ্ক মৌসুমের নভেম্বর থেকে মার্চ- এই ৫ মাসে বায়ু দূষণ হয়ে থাকে ৫৭ শতাংশ। গবেষণা বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার মানুষ মাত্র ৪৯ দিন নিরাপদ বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছে। চলতি বছরের নভেম্বরে ঢাকার মানুষ একদিনও স্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিতে পারেনি।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের মান মাত্রা বার্ষিক যেখানে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ডব্লিউএইচও এর মান মাত্রা ৫ মাইক্রো গ্রাম। অর্থাৎ আমাদের এখানে ৩ গুণ বেশি বার্ষিক গড়ে সেটি মূলত ডব্লিউএইচও এর মানমাত্রা অনুযায়ী ২০ থেকে ২১ গুণ বেশি বায়ু দূষণের ভেতরে আমরা বাস করছি। ঢাক শহরের যেই এলাকায় যখন নির্মাণ কাজ হয় ওই এলাকাটিই তখন বায়ু দূষণ প্রবণ হয়ে যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা বলছে, ২০১৯ সালে বায়ু দূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে মারা গেছে, ৭৮ হাজার থেকে ৮৮ হাজার মানুষ। সে বছর শ্বাসতন্ত্রজনিত নানা জটিলতায় রোগে ভুগেছেন ২ লাখের বেশি মানুষ।
আজ শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে অনতিবিলম্বে জরুরি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দাবিতে এক অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে জনভাষ্য ও ই-আরকি নামে দুটি পরিবেশবাদী সংগঠন।
কর্মসূচিতে ই-আরকির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিমু নাসের বলেন, যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হলো সমস্যাকে আগে স্বীকার করা। বায়ুদূষণ যে ১ নম্বর সমস্যা, তা সরকার ভাবেই না। বায়ুদূষণ কমাতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ দেখা যায় না। কারণ, তারা তো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে (এসি) থাকে। শীতকালে দূষণের কারণে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে লোকজন নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
ঢাকায় সবাই বুকভরে শ্বাস নিতে চায়, সুন্দরভাবে বাঁচতে চায় বলে মন্তব্য করেন অভিনেতা সুমন আনোয়ার। তিনি বলেন, অথচ পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ চলায় ঢাকা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বায়ুদূষণের স্থানে পরিণত হয়েছে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঢাকা বড় হচ্ছে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় যারা রয়েছেন, তারা ঠিকই তাদের কার্যালয়, বাসা ও গাড়িতে এসি স্থাপন করে দূষণমুক্ত রাখছেন। দুর্ভোগে রয়েছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে শব্দ দূষণের মাত্রাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষিত সচিবালয় এলাকায় শব্দ দূষণ হয় সর্বোচ্চ ৯৪ থেকে ১০০ ডেসিবেল, যা দিনের বেলার জন্য আর্দশ মানের শব্দ মাত্রার দুই গুণ বেশি। সম্প্রতি বিমানবন্দর এলাকাকেও নীরব এলাকা ঘোষণা করলে শব্দ দূষণ কমার কোনো প্রবণতা নেই। যদিও সেখানে থাকা চারপাশে সাইনবোর্ডের সতর্কীকরণ বেশ চোখে পড়বে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় উঠে আসে, বিমানবন্দর এলাকা থেকে লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত এলাকায় আগের চেয়ে শব্দ দূষণের মাত্রা কমে তো নাই-ই বরং কিছু ক্ষেত্র বিশেষে বেড়েছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বললেন, সচিবালয়ের চারপাশে শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি। এটি নীরব এলাকা হওয়ার আগেও বেশি ছিল। নীরব এলাকা ঘোষণার পরেও শব্দদূষণ বেশি। বাস্তবায়নে আমাদের ব্যর্থতার কারণে এলাকাগুলো নীরব হয়নি। কোনো কোনো এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণার পরপরই শব্দদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে আরও।
দুই দূষণ কমাতে সরকারের উদ্যোগ
ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদী তাৎক্ষণিক সমাধানের ক্ষেত্রে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বায়ু দূষণ রোধে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, এই টাস্কফোর্স সাময়িক ভিত্তিতে পাইলটিং হিসেবে বর্ষা মৌসুম আসা পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে প্রধান করে গঠিত টাস্কফোর্সে সিটি করপোরেশন, রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, ঢাকা ওয়াসা ও বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রাখা হবে বলে জানান তিনি।
টাস্কফোর্স গঠনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সঙ্গে নীতিগত সম্মতি প্রদান করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
ঢাকা শহরের রাস্তায় যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বসে সমন্বিত উদ্যোগে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ প্রদান করেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা।
এদিকে ঢাকা শহরে দূষণ রোধে বায়ুর মান সূচক স্বাস্থ্যকর করার জন্য নিয়মিত মোবাইল কোর্টসহ জরুরি কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মামুন উল হাসান এ সংক্রান্ত চিঠি সব কর্মকর্তাদের প্রেরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
আর শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার নতুন আইন করতে যাচ্ছে। দ্রুতই শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই এই গেজেট হবে। গেজেটে আইন প্রয়োগে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হবে।
শুক্রবার পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, হর্নের শব্দে সচিবালয়ে কাজ করা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা একটি নরকে পরিণত হচ্ছে। হর্নের যন্ত্রণায় মানুষ বিকার গ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে একটা অস্থির প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। রাজধানীতে যতগুলো সোসাইটি আছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে এ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। বিদেশে হর্ন বাজানো মানে গালি দেওয়া।
জেবি