• বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ
• পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন করলে ঝুঁকি আরও বাড়বে
বিজ্ঞাপন
• জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ চান বিশেষজ্ঞরা
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর বিরূপ প্রভাব এখন সবার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তন আসছে, অন্যদিকে মানবদেহের রোগ-জীবাণু বাড়ছে। মারাত্মক আকার ধারণ করছে পরিবেশ দূষণও। সর্বোপরি মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। যার ফলে ক্রমেই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাই সুস্থভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকতে উন্নয়নকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে এমন যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখনই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মানবস্বাস্থ্য আরও হুমকির মুখে পড়বে। কারণ এরইমধ্যে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। দিনে দিনে নতুন ভাইরাস দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রোগ-ব্যাধি বাড়ার পাশাপাশি অকাল মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন মানবস্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি এমন দাবি করে বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, আবহাওয়া, তাপমাত্রার উঠানামা, মাটি এবং পানিতে দূষণের ফলে রোগ জীবাণুর ধরন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু রোগ আবার দেখা দিচ্ছে। বেশ কিছু রোগ জীবাণুর মিউটেশন হয়ে নতুন ধরনের মারাত্মক কিছু রোগ তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে উষ্ণতা, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আইসিডিডিআর,বিতে ‘স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনারে সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। যেখানে ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ও প্রকল্প প্রধান ড. পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য তথা জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাবের কথা জানিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি। এর ফলে যেসব নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে, তার সবকিছুই বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এতে করে পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু অঞ্চল নিকট ভবিষ্যতে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এর কারণে লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি শিল্প কারখানায় পণ্য ও কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে।
তিনি আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের ওপরও বড় প্রভাব পড়ছে। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা বাড়ছে ও বায়ু দূষণ বাড়ছে।’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বৈশ্বিক উষ্ণতা, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে ভেক্টর বাহিত রোগ, ভাপ-প্রবাহ, তাপমাত্রার চাপ, বায়ু দূষণ এবং খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এই অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ে ভয়ঙ্কর বার্তা, ভাঙছে রেকর্ড
তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহের মধ্যে রয়েছে- তাপমাত্রা (১.৫০ সে. এবং ২০ সে.), বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা বা ভিন্নতা, খরা, সাইক্লোন ও অস্বাভাবিক ঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ। যা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী পানির প্রাপ্যতা, বাস্তুতন্ত্র, খাদ্য ও কৃষি, উপকূলীয় জনজীবন এবং সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব এখন দৃশ্যমান। তাই এ ব্যাপারে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন করলে, তাতে হিতে বিপরীত হবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে। তাই এখনই প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে আবহাওয়ার একটা সেতুবন্ধন রয়েছে। ফলে নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। কেবল তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। অসংক্রামক রোগও (ক্রনিক বা লাইফ স্টাইল ডিজিজ) বাড়ছে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু: জাতিসংঘ
আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে ঘনঘন এ ধরনের মহামারি দেখা দিচ্ছে, কোনোটা আবার অতিমারির রূপ লাভ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক ব্যাধিগুলোরও প্রভাব শুরু হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানির কারণে শরীরে টক্সিসিটি ইফেক্ট বেড়ে যাচ্ছে এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, দূষণের ফলে আমাদের মানসিক অশান্তিও বেড়ে যায়। এ কারণে দৈহিক, মানসিক ও সংক্রামক এবং অসংক্রামক সব রোগ শোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে।
স্বাস্থ্যগত যেসব সমস্যা বাড়ছে
২০১৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কর্তৃক কোপ-২৪ এর জন্য প্রণীত বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রকার সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে।
সুস্থভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকতে উন্নয়নকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে এমন যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এশিয়া (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম) এবং আমেরিকায় (ব্রাজিল, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া)। প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী মোট আক্রান্ত রোগীর ৮৫% ই ব্রাজিলের নাগরিক।
অন্যদিকে দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২.৫ কোটি মানুষ দাবদাহে শিকার হবার ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০০৩ সালে ইউরোপে দাবদাহের কারণে ৭০ হাজার আরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সরকারের দুর্যোগ প্রতিবেদন অনুযায়ী- জানুয়ারি ২০১৩ সালে শৈত্যপ্রবাহের কারণে ২০ জেলায় মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হবার কথা উল্লেখ করা হয়। এই দুর্যোগের কারণে প্রায় ৮০ জনের প্রাণহানি হয়, যার বেশিরভাগ শিশু ও বৃদ্ধ । এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে বন্যা, ডায়েরিয়াতেও হচ্ছে। এতে বাড়ছে প্রাণহানি।
আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করছে
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাধারণত যেসব রোগ জীবাণু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেগুলো ক্ষতিকর রূপে আবির্ভূত হয়। যে রোগগুলো অন্য কোনো পশু কিংবা প্রাণীর হওয়ার কথা, মানুষের হতো না, সেগুলো এখন পশু ও প্রাণী থেকে মানুষের হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখনই জলবায়ু পরিবর্তনে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মানবস্বাস্থ্য আরও হুমকির মুখে পড়বে। কারণ এরইমধ্যে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। দিনে দিনে নতুন ভাইরাস দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রোগ-ব্যাধি বাড়ার পাশাপাশি অকাল মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে তাত্ত্বিক ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু ইস্যুতে যা করা হচ্ছে সবই থিউরিটিক্যাল। কিন্তু এটা নিয়ে ম্যান টু ম্যান, সরকার টু সরকার প্রাকটিক্যাললি কাজ করতে হবে। আমরা ঢাকার বায়ু দূষণ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তার কিছু বাস্তবায়ন হচ্ছে, কিছু হচ্ছে না। আর এসব নিয়ে প্রশাসন ও যারা এসব কাজ করবেন তারাও সচেতন হচ্ছেন না। যাদের চিন্তা করার কথা তারাও ভাবছেন না। অথচ দিনশেষে ব্যক্তি জীবনে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সব উন্নয়ন হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে। আসলে প্রত্যেক জায়গায় অ্যাকশন নেওয়া দরকার। কারণ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’
বিইউ/জেবি