নানা কারণে বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে তাপমাত্রা বেড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফলে চরম হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পুরো বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। যে দেশ যত বেশি সচেতন হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সেই দেশে ততো দেরিতে পড়তে পারে।
বিজ্ঞাপন
ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্ব্যব্যাপী বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও এর শিকার হবেন। খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করবে। জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ারই লাখ লাখ মানুষ পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তবে উন্নত পরিবেশ, দূষণরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব হতে পারে বলে আশ্বস্তও করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও এর শিকার হচ্ছেন৷ খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করছে৷ লবণ পানির কারণে এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন৷ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন৷
ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ৬০ জনের একটি আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকার এই জরিপ কার্যক্রম চালায়।
ওই জরিপে বলা হয়েছে, উপকূলের ব্যাপক এলাকা সাগরের স্ফীত পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হবে। মিষ্টি পানির প্রবাহে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। উপকূলীয় ব্যাপক এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপও বৃদ্ধি পাবে।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণাঞ্চলীয় ৮টি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে এসব দেশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রিন হাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন আবহাওয়া ঠাণ্ডা হওয়ার কোনো প্রবণতা নেই বলে গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় দেশের তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার মূলে রয়েছে ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’।
কয়েক বছর ধরেই আবহাওয়ার ভিন্ন ধরন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। কমছে শীতকালের সময়। কমছে বৃষ্টিও। ভরা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা যায় না। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরমও।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে দেশে ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ওই মাসে ২৮৪ মিলিমিটার স্বাভাবিক গড় বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৫৯ মিলিমিটার। পুরো মাসে গড়ে ১৮ দিন বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১২ দিন। ঢাকায় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে ৪৮ শতাংশ। শুধু ঢাকা শহরেই নয়। প্রায় সারা দেশেই একই অবস্থা।
এদিকে গেল মাসে ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। গত ১৬ এপ্রিল ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ১৯৬৫ সালে রাজধানীবাসী সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন পার করেছিল। তখন ঢাকার তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল পাঁচ দশকে সর্বোচ্চ। তার আগে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল, ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৯৬০ সালে ঢাকায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি চলমান অবস্থায় আছে। আমরা যদি দেখি প্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সময়টাতে বিশেষ করে ১৯৫০ সালের পর যে তাপমাত্রাটা ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা, সেটা যাতে না বৃদ্ধি পায় সেজন্য বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো কমিটমেন্ট করেছিল। কমিটমেন্টে এটা ছিল যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা যেন না বাড়ে। কিন্তু ২০২৩ সালের মাথায় দেখা যাচ্ছে যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। সে হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে।
আজ থেকে ৩০ বছর আগে ধারণা করা হয়েছিল বিশ্বের তাপমাত্রা যদি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়বে আধা মিটার। এতে করে বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৫ ভাগ এলাকা বেশি প্লাবিত হবে। আবার লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে।
আহমদ কামরুজ্জামান আরও বলেন, আগামী ৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পস্থিতি আমাদের জন্য সুখকর নয়। যে হিসেবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা যদি চলতে থাকে, তবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য তা হুমকি তৈরি করবে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল যেমন প্লাবিত হবে, সেই সমস্ত এলাকার মানুষজন যখন নগর অঞ্চলে মাইগ্রেট করবে তখন স্বল্প ভূমির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। নগরের পরিবেশ নষ্ট হবে। আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দ্বীপ অঞ্চল যেগুলো আছে যেমন সেন্টমার্টিন, ভোলা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া এগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত বা বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের জন্য বন উজাড়কেই প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশকে সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারি হিসাব মতে শতকরা ৯ ভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বনভূমির পরিমাণ ৬ ভাগের বেশি হবে না বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দেশে বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
টিএই/এমআর