পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ভয়ঙ্কর বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া আশঙ্কাজনকভাবে বিভিন্ন রেকর্ডও ভাঙছে। এখন বিশ্বজুড়ে একের পর এক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, এবং মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফস্তর যে রেকর্ড গতিতে ভাঙছে তাতে রীতিমত শঙ্কিত বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন যেরকম দ্রুত গতিতে এবং যে সময়ের মধ্যে এসব রেকর্ড ভাঙছে তা "নজিরবিহীন"।
জাতিসংঘ বলছে, ইউরোপজুড়ে যে তাপপ্রবাহ চলছে তা আরও রেকর্ড ভাঙার দিকে এগোচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
এসব নজিরবিহীন রেকর্ড জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা তা এখুনি হলফ করে বলা কঠিন, কারণ আবহাওয়া এবং পৃথিবীর মহাসাগরের আচরণ খুবই জটিল।
এগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই শঙ্কিত যে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতি ঘটতে চলেছে।
"আমার এমন কোনো সময়ের কথা জানা নেই, যখন আবহাওয়া মণ্ডলের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বত্র এ ধরনের রেকর্ড ভাঙা এবং অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটছে," বলছেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের পরিবেশ বিষয়ক ভূগোল বিশেষজ্ঞ টমাস স্মিথ।
"পৃথিবী এখন লাগামহীন পরিবর্তনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে" যার পেছনে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ঘটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং ২০১৮ সাল থেকে 'এল নিনো'র প্রভাবে প্রথম পৃথিবীর গরম হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু - বলছেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জলবায়ু বিজ্ঞানের লেকচারার ড. পল সেপ্পি।
বিজ্ঞাপন
এল নিনো প্রকৃতি গরম হয়ে ওঠার একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা হয় যখন প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণমণ্ডলীয় অংশে সমুদ্রের তপমাত্রা স্বাভাবিকের উপরে উঠে যায়, যার প্রভাবে প্রকৃতি গরম হয়ে ওঠে।
এখানে তুলে ধরা হলো এ বছর গ্রীষ্ম মরশুমে যে চারটি রেকর্ড ভাঙা অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গেছে এবং এর প্রভাব কী হতে পারে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে গরম দিনের রেকর্ড
এ বছর জুলাই মাসে ছিল এ যাবৎ পৃথিবীতে সবচেয়ে গরম দিনের রেকর্ড। ২০১৬ সালে বিশ্বে গড় সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রার যে রেকর্ড ছিল এবারের তাপমাত্রা তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
এবার প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৭ সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ইইউর জলবায়ু পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপার্নিকাস জানাচ্ছে ৬ জুলাই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭.০৮।
তেল, কয়লা ও গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে যে কার্বন নিগর্মণ হচ্ছে পৃথিবীর ক্রমশ গরম হয়ে ওঠার পেছনে সেটাই বড় কারণ।
ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের আরেকজন জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. ফ্রেডেরিকো অটো বলছেন, গিনহাউস গ্যাস থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া ঠেকানো না গেলে এমনটাই ঘটবে বলে পূর্বাভাস করা হয়েছিল। এর জন্য মানুষই দায়ী। আমি যে কারণে বিস্মিত সেটা হলো জুন মাসে যেভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড ভাঙছে। বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে এত তাড়াতাড়ি এমনটা ঘটার কথা নয়।"
তিনি বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে, কিন্তু সেটার প্রভাব এত তাড়াতাড়ি দেখা যাওয়াটা অস্বাভাবিক।
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গরম মাস ছিল জুন
এ বছর জুন মাসে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল জুনের স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে ১.৪৭ সেলসিয়াস বেশি। এই বৃদ্ধি হিসাব করা হয় পৃথিবীতে শিল্পোন্নয়ন ঘটার আগের সময়কার সঙ্গে তুলনা করে।
১৮০০ সাল নাগাদ বিশ্বে শিল্প বিপ্লব ঘটার পর থেকে মানুষ আবহাওয়া মণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করছে অনেক বেশি।
ড. স্মিথকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এক দশক আগে তারা কি বুঝতে পেরেছিলেন ২০২৩ সালের গ্রীষ্ম মরশুমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এই পর্যায়ে পৌঁছবে?
তার উত্তর ছিল জলবায়ুর যে মডেল ধরে পূর্বাভাস দেওয়া হয় তাতে দীর্ঘমেয়াদে কী ঘটতে যাচ্ছে তার পূর্বাভাস দেওয়া যায়, কিন্তু আগমী দশ বছরে কী ঘটবে তা বলা কঠিন।
"১৯৯০ সালে আবহাওয়ার আচরণের যে মডেল ধরে আমরা কাজ করেছিলাম তাতে আজকের অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি একটা সঠিক ধারণাই পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু আগামী দশ বছরে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে তার সঠিক পূর্বাভাস এখন দেওয়া কঠিন হবে," তিনি বলেন।
পৃথিবী এই সময়ের মধ্যে যথেষ্ট ঠাণ্ডা হবে না বলেই তার মত।
চরম সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ
বিশ্বব্যাপী মহাসাগরের তাপমাত্রা মে, জুন এবং জুলাই মাসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
২০১৬ সালে সমুদ্র পৃষ্ঠের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রার যে রেকর্ড ২০১৬ সালে ধরা পড়েছিল বর্তমান তাপমাত্রা দ্রুত তাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তাপমাত্রা যে অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ছে তাতে বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে শঙ্কিত।
"আটলান্টিকের এই অংশে এ ধরনের সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ আগে কখনও দেখা যায়নি। এটা আমাদের ধারণার বাইরে," বলেছেন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবী বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েলা শ্মিড।
আর্য়াল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের তাপমাত্রা জুন মাসে স্বাভাবিকের চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওপরে ছিল। যা ন্যাশানাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সংজ্ঞায় ক্যাটেগরি ৫ তাপপ্রবাহ অর্থাৎ "চরম অবস্থারও বেশি"।
এর কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন কিনা তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তবে তিনি বলছেন পৃথিবী গরম হয়ে উঠেছে এটা পরিষ্কার এবং মহাসাগরগুলো আবহাওয়া মণ্ডল থেকে অতিরিক্ত উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে সমুদ্রের জীববৈচিত্র সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রের এই জীববৈচিত্র পৃথিবীর ৫০% অক্সিজেন জোগায়।
"আমরা যখন তাপপ্রবাহের কথা বলি মানুষ ভাবে তাতে শুধু গাছপালা, ঘাসপাতা মরে যায়। কিন্তু মহাসাগরের পানি যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি বেড়ে যায়, তখন সামুদ্রিক জীব ও গাছপালার বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি ৫০% খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
দক্ষিণ মেরু সাগরে বরফের স্তর রেকর্ড কমেছে
দক্ষিণ মেরু সাগরে বরফের স্তর জুলাই মাসে ছিল রেকর্ড পরিমাণ কম। ব্রিটেনের আয়তনের দশগুণ পরিমাণ আয়তনের বরফের স্তর গলে গেছে। ১৯৮১ থেকে ২০১০এ সেখানে যে পরিমাণ বরফের আস্তরণ ছিল, তা রেকর্ড মাত্রায় কমে গেছে।
কেন এই পরিবর্তন - এর কারণ কি জলবায়ুর পরিবর্তন তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা রীতিমত চিন্তিত।
পৃথিবীর আবহাওয়া যেরকম আশঙ্কাজনকভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে, তাতে দক্ষিণ মেরু সাগরের বরফের স্তর উদ্বেগজনক হারে গলে যাচ্ছে। তবে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের ড. ক্যারোলাইন হোমস ব্যাখ্যা করছেন যে এটা স্থানীয় আবহাওয়ার কারণে অথবা মহাসমুদ্রের কারেন্টের ফলেও ঘটতে পারে।
তিনি বলছেন, এটা শুধু রেকর্ড ভাঙার কারণে উদ্বেগ নয়, যে মাত্রায় রেকর্ড ভাঙছে তা তাদের ভাবাচ্ছে।
"জুলাই মাসে এই পরিমাণ বরফ গলা আমরা আগে কখনও দেখিনি। এর আগে বরফ গলে যে মাত্রায় নেমে এসেছিল এই মাত্রা তার আরও ১০% নিচে। এট বিশাল।
তিনি বলছেন "যে দ্রুত হারে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তার কারণ যে আমাদের কাছে এখনও কতটা ধাঁধাঁর মতো এটা তার আর একটা উদাহরণ।"
আসলে এত দ্রুত পরিবর্তনগুলো ঘটছে - এত দ্রুত গতিতে আগের রেকর্ডগুলো ভাঙছে সেটাই বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করছে।
তারা বলছেন, আগামীতে আবহাওয়া মণ্ডলের আরও রেকর্ড ভাঙা অঘটনের আশঙ্কা তারা করছেন। ২০২৪ সালে গিয়েও নানা দুর্যোগ ঘটবে বলে তারা মনে করছেন।
তবে ড. অটো বলেছেন, এর মানে এই নয় যে "জলবায়ু ধ্বংস" হয়ে গেছে। তিনি বলছেন নতুন পরিস্থিতির আলোকে "পৃথিবীকে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী করে তোলার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি"।
সূত্র : বিবিসি
MHH/এমইউ