প্রায় ৩৬ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের প্রবাসী সাহাঙ্গীর সরদার। সেখানে তিনি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেন, দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। ফলে বাংলাদেশ সরকার তাকে মূল্যায়ন করে। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে ২০২১ ও ২৩ সালে সিআইপি সম্মানে ভূষিত হন তিনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের হাত থেকে সিআইপি পদকও নেন এই প্রবাসী। সেই স্মৃতি তার ফেসবুকের অ্যালবামে এখনো শোভা পাচ্ছে। আর এটাই যেন তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি চক্র তাকে ‘আওয়ামী লীগের অর্থদাতা’ আখ্যা দিয়ে বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও তার নামে মিথ্যা মামলা দেয়। ফলে তিনি এখন দেশছাড়া। চক্রটি মামলা থেকে নাম বাদ দিতে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। যদিও সেই মামলায় সাহাঙ্গীরের সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ।
বিজ্ঞাপন
এদিকে বাধ্য হয়ে সাহাঙ্গীর থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেছেন। তবে মামলা করে উল্টো তিনি এখন বিপাকে। একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও বাকিরা জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে তার পরিবার আতঙ্কে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে।
সাহাঙ্গীর জানান, যারা তার কাছে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিএনপির যাত্রাবাড়ী থানার নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তবে কোনো প্রতিকার পাননি।
সাহাঙ্গীর জানান, তিনি গত জুনে দেশে আসেন। ৫ আগস্ট হঠাৎ তার বাড়িতে হামলা করে বসে পলাশ ও স্বজন বাহিনীর লোকজন। তারা ৪০০ থেকে ৫০০ লোকজন নিয়ে যাত্রাবাড়ীর চারতলা বাসায় হামলা করে। প্রথমে তারা বাড়ির গেট ভাঙে, পরে নিচতলা, দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। সেই রাতে তিনি ও তার পরিবার পুলিশি সহায়তা চান। কিন্তু পুলিশ তাকে কোনো সহায়তা করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
প্রবাসী এই ব্যবসায়ী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যখন বিপদে পড়লাম কদমতলী থানার সহায়তা চাইলাম। তারা এলো, কিন্তু ওই রাতে আর কোনো হেল্প করল না। ফিরে গেল। এমন দেশের নাগরিক আমি, পুলিশ সাহায্য করতে চায় না। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির সাবেক এমপি সালাউদ্দিনের ছেলে রবিন, কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বরকেও জানিয়েছে আমার স্ত্রী ও পরিবার। কিন্তু তারা কোনো প্রকার সাহায্য করেননি।’
সাহাঙ্গীর বলেন, ‘ভাই! সিআইপি হওয়া কি আমার অপরাধ। আমি তো কোনো রাজনীতি করি না। একজন সিআইপি হলে কি আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে যায়! আমি তাদের ভয়ে আজ দেশছাড়া। আসার দিন আমার জুতাটাও নিয়ে আসতে পারিনি। পুলিশ কোনো হেল্প করেনি। যাদের জন্য কষ্ট করে রেমিট্যান্স পাঠাই তারাই যদি দেশ থাকতে না দেন তাহলে এত রেমিট্যান্স আহরণ করে কী লাভ? বিদেশে বসে আয়ের টাকা যদি দেশে পাঠিয়েও চাঁদা দিতে হয়, তাহলে এই দেশ কি আসলে আমার?’
এ ব্যাপারে সিআইপি সাহাঙ্গীর সরদার প্রধান উপদেষ্টা, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সহায়তা চেয়েছেন। তবে এখনো কেউ তার আহ্বানে সাড়া দেননি।
কদমতলী বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলাম পলাশ, ৫৩নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা স্বপন মিয়া, কামরুল ইসলাম, জুয়েল (কালা জুয়েল) এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন সাহাঙ্গীর সরকার। এছাড়া তাদের সঙ্গে আলম হোসেন, রানা, বশির, সাগির, সোহাগ, আশিকুল ইসলাম আদর্শসহ ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীরা ছিলেন। এই তালিকার সবাইকে মামলার আসামি করেছেন সাহাঙ্গীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তরিকুল ইসলাম পলাশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৫৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কামরুল ইসলাম ৫৩ ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। জুয়েল এই ওয়ার্ডের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক। অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন স্বপন কদমতলী থানার ৫৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে তরিকুল ইসলাম পলাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন সিআইপি। তার বাড়ির একটা ইটও আমরা নিইনি। আমি তো তাকে তেমন চিনিও না। তিনি মূলত বিএনপি নেতা রবিনের কথায় আমাকে আসামি করেছেন।’
পলাশ বলেন, ‘আমি কদমতলীর সাইফুল গ্রুপের হওয়ায় এ মামলায় জড়িয়েছে। তবে আমি সেদিন ঘটনাস্থলে গেছিলাম, এটা সত্য। জুয়েল আইসা কইলো চল যাই, জাহাঙ্গীরের নামে তো মামলা আছে, তারে ধরায় দিই। সেখানে যাওয়াটাই আমার ভুল ছিল। আমার বিরুদ্ধে কেউ বলতে পারবে না, কারো কাছে চান্দা চাইছি। সিআইপি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ছবি বড় কইরা লাগাইয়া দিয়া ছয় সাতটা বাড়ি করছে। হয়ত লোকজন এ কারণে ক্ষুব্ধ হইয়া তার বাড়িতে ভাঙচুর করবার পারে।’
আরও পড়ুন
গাড়িচালকের ছেলে যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী
কনস্টেবল হত্যায় দুই লাখে খুনিদের ভাড়া, অংশ নেন স্ত্রীও
জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে সাহাঙ্গীরের স্ত্রী কদমতলী থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলা করেন। সেই মামলায় বিএনপি নেতা পলাশ ও স্বপনকে আসামি করা হয়েছে। তার মধ্যে আলম নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বাকিরা এখন জামিনে রয়েছেন।
মামলার বাদী সাহাঙ্গীরের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো মামলা করলাম, কিন্তু পুলিশ তো আসামি ধরে না। তাহলে আমাদের মামলা করে কী লাভ হলো? আমার স্বামী একজন প্রবাসী ও সিআইপি হয়েও কোনো আইনি সহায়তা পাচ্ছে না। আমরা আজ ভয়ে বাড়িছাড়া। জীবনের ভয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছি।’
এ বিষয়ে কদমতলী থানার এসআই ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মাফরুক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। সিআইপি জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছিল চক্রটি। বিষয়টি ইতোমধ্যে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা জামিনে আছেন। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে।’
তবে কদমতলী এলাকার সাবেক এমপি সালাউদ্দিনের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপি নেতা তানভীর আহমেদ রবিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এমআইকে/জেবি

