ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন হলো গ্রীষ্মমন্ডলী ঝড় বা বায়ুমন্ডলীয় একটি উত্তাল অবস্থা যা বাতাসের প্রচন্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত হয়। এটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের একটি।
পৃথিবীর ৩০º উত্তর এবং ৩০º দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ব্যতীত পৃথিবীর বাদবাকি গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাগরাঞ্চল যে মারাত্মক বায়ুমন্ডলীয় দুর্যোগসমূহ জন্ম দিচ্ছে তা সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে গড়ে ৮০টি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়।
বিজ্ঞাপন
ঘূর্ণিঝড়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সাইক্লোন’ গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ (Kyklos) থেকে এসেছে। কাইক্লোস শব্দের অর্থ কুন্ডলী পাকানো সাপ।
ঘূর্ণিঝড়ের উপগ্রহ চিত্র থেকে এমনতর নামকরণের যথার্থতা বোঝা যায়। ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিদ হেনরী পিডিংটন ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত সামুদ্রিক দুর্যোগ বিষয়ক পুস্তক The Sailor’s Horn-book for the Law of Storms -এ প্রথমবারের মতো সাইক্লোন শব্দটি ব্যবহার করেন।
একটি অঞ্চলে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে একটি কেন্দ্রাভিমুখী ঘূর্ণায়মান প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ থেকেই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। উত্তর গোলার্ধে এ বায়ু ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী অর্থাৎ উত্তরাভিমুখী এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণাভিমুখী প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং এ অঞ্চলের বাইরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডল বহির্ভূত ঘূর্ণিঝড়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সাধারণভাবে ধ্বংসাত্মক এবং বাংলাদেশে তা প্রভূত ক্ষতিসাধন করে থাকে।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়কে আমেরিকা মহাদেশে ‘হারিকেন’, দূরপ্রাচ্যে ‘টাইফুন’, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বলা হয় সাইক্লোন এবং বাংলায় ঘূর্ণিঝড়। পাশ্চাত্যে হারিকেনকে মানুষের নামেও চিহ্নিত করা হয়। যেমন-মিচেল, এনড্রু, ক্যারল, ডরোথি এবং ইভ। তবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে এ ধরনের নামকরণ প্রবণতা নেই। কখনও কখনও মধ্য অক্ষাংশ অঞ্চলে এটিকে নিম্নচাপ বলা হলেও বর্তমানে সাইক্লোন শব্দটি হারিকেনধর্মী গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপকে প্রকাশের জন্যই ব্যবহূত হচ্ছে, বিশেষত যখন তা ভারত মহাসাগর থেকে উদ্ভূত হয়। বাংলায় এর আরেকটি প্রচলিত নাম ‘তুফান’ যা চীনা শব্দ ‘টাইফুন’ থেকে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলের অংশ, যার উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের প্রান্তে রয়েছে অনেকটা চোঙ আকৃতির উপকূলভাগ। বাংলাদেশের এ স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান মৌসুমীবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো এবং বন্যাও বয়ে আনে। বঙ্গোপসাগর গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির একটি আদর্শ ক্ষেত্র।
ঘূর্ণিঝড় সাধারণত গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হয় বিধায় এ সম্পর্কে যথাযথ অনুসন্ধানের কাজটি খুব সহজ নয়। মহাশূন্য গবেষণার অগ্রগতির ফলে আবহাওয়া উপগ্রহগুলো এ সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য দিতে পারায় অনুসন্ধানের কাজে কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছে। উন্নত দেশসমূহ বিমান থেকে নিরীক্ষণ এবং ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সরাসরি অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় নিরীক্ষণ এবং অনুসন্ধানকর্মের সূত্রপাত ঘটেছে।
ঘূর্ণিঝড় কত প্রকার?
শ্রেণীবিভাগ বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা অনুসারে এর শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যভিত্তিক নামকরণ ব্যবহূত হচ্ছে- নিম্নচাপ (বাতাসের গতিবেগ ৬২ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত), ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ৬৩-৮৭ কিমি/ঘণ্টা), তীব্র ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ৮৮-১১৮ কিমি/ঘণ্টা) এবং হারিকেনের তীব্রতাসহ ঘূর্ণিবাত্যাবিশিষ্ট ঝড় (বাতাসের গতিবেগ ১১৮ কিমি/ঘণ্টার উপরে)।
ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি কোথায়?
উৎপত্তি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭°সে. এর উপরে থাকা প্রয়োজন। অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি ঘটে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে। সাধারণত ৫° উত্তর থেকে ৩০° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির উৎপত্তি ঘটে। ধারণা করা হয় যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ক্ষেত্রে আন্তঃক্রান্তীয় মিলন বলয় (Inter-tropical Convergence zone) - এর কিছু ভূমিকা রয়েছে।
আন্তঃক্রান্তীয় মিলন বলয়ের অবস্থান হলো বিষুবরেখার কাছাকাছি, যেখানে দুই গোলার্ধের বায়ুপ্রবাহ এসে মিলিত হয়, তবে এর অবস্থান ঋতুভেদের ওপর নির্ভর করে। একটি ঘূর্ণিঝড় পৃথিবীর আবর্তন থেকে সৃষ্ট ‘কোরিওলিস ফোর্স’ থেকে তার ঘূর্ণায়মান গতি প্রাপ্ত হয়। কার্যত বিষুবরেখায় এ শক্তি শূন্যের (০) পর্যায়ে থাকে। সুতরাং ঘূর্ণিঝড়গুলি ঠিক বিষুবরেখা থেকে সৃষ্টি হয় না। প্রয়োজনীয় ঘূর্ণিগতির জন্য ঝড়গুলির উৎপত্তি ঘটে বিষুবরেখা থেকে কিছুটা উত্তর দিকে। সম্ভবত পূর্বদিক থেকে আসা ঢেউরাজিও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় কিছু ভূমিকা রাখে।
বিভিন্ন ধরনের বায়ুমন্ডলীয় বিপর্যয়ের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় হলো সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। একটি ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাস ৩০০ থেকে ৬০০ কি.মি. পর্যন্ত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ে সবসময়ই বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ১১৮ কি.মি. এর বেশি এবং তা শক্তিশালী নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয়।
নিম্নচাপ কেন্দ্রে বায়ুর চাপ থাকে ৫০ থেকে ৬০ হেক্সা প্যাসকেল এবং প্রান্তদেশে এর পরিমাণ আরও বেশি হয়। প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা এবং সুপ্ত তাপ নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে বয়ে নিয়ে আসে যা ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। সাপের মতো কুন্ডলী পাকানো ঘূর্ণায়মান বাতাস নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হলে সেখানে প্রচন্ড গতিবেগ সৃষ্টি করে।
ঘূর্ণিঝড়ের চোখ কী?
ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর গাঠনিক চিত্র হলো এর ‘চোখ’। উপগ্রহ চিত্রগুলোতে এ চোখের গঠন বা আকৃতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের চোখের মতো অংশটি ক্ষুদ্র এবং প্রায় বৃত্তাকার বা কখনও এটি চ্যাপ্টা হয়। এ অঞ্চলের ব্যাস থাকে ৮-৫০ কিমি। চোখে বায়ুচাপ থাকে সর্বনিম্ন এবং তাপমাত্রা থাকে সর্বোচ্চ। ঘূর্ণিঝড়ের চোখ যত উষ্ণ থাকে ঝড় ততো বেশি শক্তিশালী হয়। চোখে বায়ুপ্রবাহ থাকে খুবই হালকা (সাধারণত ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ কিমি-এর বেশি নয়) এবং মেঘ থাকে না বললেই চলে। এর বিপরীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যায় চোখটির পরিসীমার বাইরে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় যাকে চোখ-দেয়াল বলা হয়। এখানে বাতাসের বেগ এবং বৃষ্টিপাত সবচেয়ে বেশি।
ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ
প্রাথমিক পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় ঘণ্টায় ৫-১০ কি.মি. হারে উৎপত্তি স্থল থেকে অগ্রসর হতে থাকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এ গতি ঘণ্টায় ২০-৩০ কিমি, এমনকি ঘণ্টায় ৪০ কিমি পর্যন্ত হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণত প্রারম্ভে উত্তর-পশ্চিমমুখী এবং পরবর্তী পর্যায়ে পূর্বদিকে বেঁকে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তবে সংঘটিত বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ বিচারে উল্লিখিত প্রবণতা সবসময় প্রকাশ করে না। ঘূর্ণিঝড়ের অনুষঙ্গ হলো ভারি বর্ষণ এবং সমুদ্রের জলরাশির স্ফীতি, যাকে বলা হয় জলোচ্ছ্বাস। যদি সমুদ্রে জোয়ারকালীন এমন ঘটে তবে তুলনামূলকভাবে জলোচ্ছ্বাস আরও জোরদার হয় এবং তা ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসের মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাচীরাকৃতি পানির প্রবাহ জীবন ও সম্পদের সমূহ ক্ষতি সাধন করে।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া
এজেড