আমরা জানি, মেঘের উপরে থাকে পজিটিভ চার্জ আর নীচে থাকে নেগেটিভ চার্জ। যেহেতু বিপরীতধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে, তাই এই পজিটিভ চার্জ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরের সংস্পর্শে আসলে উপর থেকে নীচের দিকে চার্জের নির্গমন ঘটে। এর ফলে শক্তির নিঃসরণ ঘটে, শব্দ হয় ও আলোর ঝলকানি সৃষ্টি হয়। কিন্তু হাদিসে (তিরমিজি: ৩১১৭) এই শব্দকে ফেরেশতাদের হাঁকডাক বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এ হাঁকডাক দিয়েই মেঘমালাকে নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাদিসটি হলো—ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইহুদিরা নবী (স.)-এর নিকট এসে বলল, হে আবুল কাসিম! আমাদেরকে রা’দ (মেঘের গর্জন) প্রসঙ্গে বলুন, এটা কী? তিনি বললেন, মেঘমালাকে হাঁকিয়ে নেয়ার জন্য ফেরেশতাদের একজন নিয়োজিত আছে। তার সাথে রয়েছে আগুনের চাবুক। এর সাহায্যে সে মেঘমালাকে সেদিকে পরিচালনা করেন, যেদিকে আল্লাহ তাআলা চান। তারা বলল, আমরা যে আওয়াজ শুনতে পাই তার তাৎপর্য কী? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- এটা হচ্ছে ফেরেশতার হাঁকডাক। এভাবে হাঁকডাক দিয়ে সে মেঘমালাকে তার নির্দেশিত স্থানে নিয়ে যায়। তারা বলল, আপনি সত্য বলেছেন। তারা আবার বলল, আপনি আমাদের বলুন, ইসরাঈল ইয়াকুব (আ.) কোন জিনিস নিজের জন্য হারাম করেছিলেন? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- তিনি ইরকুন নিসা (স্যায়াটিকা) রোগে আক্রান্ত ছিলেন কিন্তু উটের মাংস ও এর দুধ ছাড়া তার উপযোগী খাদ্য ছিল না। তাই তিনি তা হারাম করে নিয়েছিলেন। তারা বলল, আপনি সত্য বলেছেন। (তিরমিজি: ৩১১৭; সহিহাহ: ১৮৭২, আবু ঈসা বলেন, হাদিসটি হাসান সহিহ গারিব)
বিজ্ঞাপন
হাদিসের কথা এবং বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই। কারণ দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতারা বিচ্ছিন্ন মেঘমালাকে একত্রিত করার জন্য আগুনের চাবুক দিয়ে আঘাত করে তখন যে চার্জ সৃষ্টি হয় তাতেই গর্জন ও আলো বিচ্ছুরিত হয়। আবার ফেরেশতারা যখন মেঘমালাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, তখনও তাদের হাতে থাকা চাবুক দিয়ে আঘাত করে। ফলে বিপরীতধর্মী চার্জ সৃষ্টি হয় এবং তাতেই বজ্রপাত এবং আলো বিচ্ছুরিত হয় (ইবনু তাইমিয়া, মাজমুউল ফতোয়া: ২৪/২৬৩-৬৪; মিরআত: ৫/২০৭; মিরকাত: ৩/১১১৯)
আলোর গতি তুলনামূলক বেশি হওয়ায় পৃথিবীতে আলোর আগমন ঘটে আগে এবং শব্দের আগমন ঘটে পরে। যেমন রাসুল (স.) বলেন, মেঘমালাকে হাঁকিয়ে নেওয়ার জন্য ফেরেশতাদের একজন নিয়োজিত আছে। তার সাথে রয়েছে আগুনের চাবুক। এর সাহায্যে সে মেঘমালাকে সেদিকে পরিচালনা করে, যেদিকে আল্লাহ তাআলা চান। তারা বলল, আমরা যে গর্জন শুনতে পাই তার তাৎপর্য কি? রাসুল (স.) বললেন, এটা হচ্ছে ফেরেশতার মেঘমালাকে আঘাত করে তাড়ানোর গর্জন। এভাবে আঘাত করে সে মেঘমালাকে তার নির্দেশিত স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যায় (তিরমিজি: ৩১১৭)
ইবনে আববাস (রা.) বলেন, বজ্রধ্বনি সৃষ্টিকারী হলেন একজন ফেরেশতা। তিনি মেঘমালাকে হাঁকিয়ে নিয়ে যান, যেমন রাখাল তার মেষপালকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। (আল-আদাবুল মুফরাদ: ৭২২)
বিজ্ঞাপন
আমরা জানি যে ফেরেশতাদের সংখ্যা অগণিত এবং তারা বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত। এ বিষয়ে ঈমান রাখা ফরজ। মৃত্যু অবধি ফেরেশতাগণ প্রতি মুহূর্তে বান্দার সহযোগিতায় থাকেন (সুরা রাদ: ১১; ইনফিতার: ১০-১১; ক্বাফ: ১৭-১৮)। মেঘ, বৃষ্টিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ফেরেশতাদের সরাসরি ভূমিকা থাকে। গতিসম্পন্ন বাতাসের মতো অবস্থা সৃষ্টি করা কিংবা মেঘের দৌড়ানি ইত্যাদি সম্পন্ন করা তাদের পক্ষে সহজ। হাদিসের ভাষ্যমতে সব অবস্থা তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন করে থাকেন। মহাকাশজুড়ে অবস্থানরত ফেরেশতাদের মধ্যে শুধু সেজদারত অবস্থায় রয়েছেন অগণিত ফেরেশতা।
আবু জার (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি দেখি, যা তোমরা দেখতে পাও না এবং শুনি, যা তোমরা শুনতে পাও না। আকাশ কটকট করে শব্দ করছে। আর এ শব্দ তার করা সাজে। এতে চার আঙ্গুল পরিমাণ এমন জায়গা নেই, যেখানে কোনো ফিরিশতা আল্লাহর জন্য সেজদায় নিজ কপাল অবনত রাখেননি। আল্লাহর কসম! তোমরা যদি জানতে যা আমি জানি, তবে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে এবং বিছানায় তোমরা স্ত্রীদের সাথে আনন্দ উপভোগ করতে না। (বরং) তোমরা আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার জন্য পথে পথে বের হয়ে যেতে।’ (আহমদ: ২১৫১৬, তিরমিজি: ২৩১২, ইবনে মাজাহ: ৪১৯০, হাকেম: ৩৮৮৩, সিলসিলা সহিহাহ: ১৭২২)
আরও পড়ুন: ১১ শ্রেণির মানুষের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন
সুতরাং এই বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যে ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁরা নানা দায়িত্বে নিয়োজিত। মেঘের গর্জন, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির দায়িত্ব ফেরেশতাদের। সুতরাং মেঘের গর্জনের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিস ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সঙ্গে বিরোধ নেই। এরপরও মনে রাখা উচিত যে প্রাসঙ্গিক হাদিসটি অনেকের মতে সহিহ হলেও পূর্ববর্তীদের অনেকে একে জইফ বা দুর্বল বলেছেন। যেমন শাওকানী (র.) তাঁর তাফসিরে বলেছেন, ‘এর বর্ণনাক্রম দুর্বল’। শুআইব আরনাউত তাঁর মুসনাদ আহমদের ব্যাখ্যায় এবং সমকালীন কিছু আলেমও এই হাদিসকে দুর্বল বলেছেন। আর দুর্বল হাদিস আমলে না নিলে অসুবিধা নেই।
এরপরও যদি আমরা ধরে নিই যে হাদিসটি বিশুদ্ধ, সেই সাথে বজ্র তৈরি হবার বৈজ্ঞানিক কার্যকারণকেও মাথায় রাখি, তবুও অধিবিদ্যামূলক (Metaphysical) কারণগুলো সুনিশ্চিত। যেমন, জাগতিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে ফেরেশতাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ সাংঘর্ষিক নয়। উভয়েই আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মৃত্যুর ফেরেশতা কর্তৃক আত্মা নিয়ে নেওয়ার কারণে সবাই মারা যায়। কিন্তু এটি একজন ব্যক্তির মৃত্যুর জাগতিক বিভিন্ন কারণের সাথে সাংঘর্ষিক নয় যেমন- হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া, কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কিংবা অন্য কোনো কারণ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর ওপর সুদৃঢ় ঈমান রাখার এবং আমলে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মেঘের গর্জন, ফেরেশতাদের হাঁকডাক, বজ্রপাত হাদিস, বৃষ্টির সময় আকাশে যে মেঘের আওয়াজ হয় তা ফেরেশতাদের গর্জন, তিরমিজি ৩১১৭, বজ্রপাতের আওয়াজ কি ফেরেশতাদের?