শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ফেরেশতাদের আমল

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ফেরেশতাদের আমল

ফেরেশতা আল্লাহ তাআলার এক রহস্যময় সৃষ্টি। কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁরা নূরের তৈরি। বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন তাঁরা। ফেরেশতারা খুবই শক্তিশালী, কিন্তু সব ধরনের চাহিদা থেকে মুক্ত। তাঁদের সংখ্যা অগণিত। মর্যাদা ও দায়িত্বের বিচারে ফেরেশতারা একাধিক শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রধান চার ফেরেশতার নাম হলো— হজরত জিব্রাইল, হজরত মিকাইল, হজরত আজরাইল ও হজরত ইসরাফিল (আ.)। ফেরেশতাদের ওপর ঈমান আনা মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের ‘নিজের অনুগত ও সম্মানিত বান্দা’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছে। আল্লাহ এ থেকে পূতপবিত্র। বরং তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা।’ (সুরা আম্বিয়া: ২৬) 

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ফেরেশতাদের মর্যাদা সমুন্নত ও উচ্চ। কথা ও কাজে তাঁরা আল্লাহর পরিপূর্ণ অনুগত। আল্লাহর আদেশ মান্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। আল্লাহর নির্দেশই তাঁদের ক্রিয়াশীল করে এবং তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেয়। সৃষ্টিজগতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ছাড়াও আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকা ফেরেশেতাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁদের ইবাদতের বিভিন্ন বিবরণ কোরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়। যেমন—

তাসবিহ পাঠ
ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকেন। তাসবিহ পাঠের (আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা) মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহকে স্মরণ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফেরেশতারা আল্লাহর সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে।’ (সুরা আশ-শুরা: ৫) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা দিন-রাত তাসবিহ পাঠ করে; তারা ক্লান্ত হয় না।’ (সুরা আম্বিয়া: ২০)

আর ফেরেশতারা আল্লাহর যে তাসবিহ ও পবিত্রতা ঘোষণা করেন, তা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ জিকির। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন জিকিরটি উত্তম? তিনি বলেন, যা ফেরেশতা ও বান্দাদের জন্য আল্লাহ নির্বাচন করেছেন—সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি। অর্থ: আল্লাহ পূতপবিত্র এবং সব প্রশংসা শুধু তাঁর জন্যই। (সহিহ মুসলিম: ৪৯১৬)

নামাজ ও সেজদা
কিছু ফেরেশতা সবসময় নামাজে রত আছেন। তাঁদের কেউ রয়েছেন সেজদারত অবস্থায়, কেউ রুকুতে। আর তাঁরা নামাজ আদায় করছেন সারিবদ্ধ হয়ে ও সুশৃঙ্খলভাবে। হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তোমরা কি সারিবদ্ধ হবে না, যেমন ফেরেশতারা আল্লাহর নিকট সারিবদ্ধ হয়ে থাকে। (সহিহ মুসলিম: ৬৫৬)


বিজ্ঞাপন


হজরত হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আসমানে এমন এক বিঘত জায়গা নেই, যেখানে কোনো ফেরেশতা সেজদা বা নামাজরত নেই। (তিবরানি) আর সুরা সাফফাতে ফেরেশতাদের জবানিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আপনার সেজদাকারী।’ (সুরা সাফফাত: ১৬৬)

হজ
মানুষের মতো ফেরেশতাদেরও কাবা রয়েছে। তাঁরা সেই কাবাঘরের জিয়ারত করেন, তাওয়াফ করেন, হজ পালন করেন। সপ্তম আসমানে অবস্থিত আল্লাহর এই কাবার নাম বায়তুল মামুর। বাইতুল মামুর দুনিয়ার কাবার ঠিক ওপরে অবস্থিত। যদি বাইতুল মামুরকে ভেঙে ফেলা হয় তাহলে ঠিক কাবা শরিফের ওপর আছড়ে পড়বে। মিরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (স.) এখানে পৌঁছে ইবরাহিম (আ.)-কে বাইতুল মামুরের প্রাচীরে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পান। (বুখারি: ৩২০৭)

প্রতিদিন হাজার হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করে থাকেন পবিত্র এই ঘরকে। যে ফেরেশতা একবার তাওয়াফ করেছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার এখানে ফিরে আসেন না। মিরাজের রাতে রাসুল (স.) বাইতুল মামুর দেখে জিবরাঈল (আ.)-কে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি বলেন, এটি বায়তুল মামুর। প্রতিদিন এখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা নামাজ আদায় করেন। যাঁরা এখান থেকে একবার বের হন, দ্বিতীয়বার ফিরে আসেন না। (বুখারি: ৩২০৭)

মানুষের প্রহরী হিসেবে কাজ করা
ফেরেশতাদের অন্যতম একটি কাজ হলো তারা আল্লাহর হুকুমে তাঁরই মর্জিমতো মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে। তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।’ (সুরা রাদ: ১১)

কল্যাণের কাজে উৎসাহ দেওয়া
শয়তান যখন মানুষকে অন্যায় ও খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করে ফেরেশতারা তখন মানুষকে কল্যাণের দিকে যেতে প্রেরণা যোগায়। হাদিসে এসেছে, ‘শয়তান মানুষের মনে প্রেরণা জাগায় আবার ফেরেশতারাও মানুষের মনে প্রেরণা জাগায়। শয়তানের প্রেরণা অশুভ ও অকল্যাণের ওয়াদা করা এবং সত্যকে অস্বীকার করার প্রেরণা। আর ফেরেশতার প্রেরণা হলো কল্যাণ ও মঙ্গলের ওয়াদা করা এবং সত্যকে মেনে নেয়ার প্রেরণা। অতঃপর তিনি কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেন- 

‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভীতি দেখায় এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদের নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা: ২৬৮)

মাগফেরাতের দোয়া করা
মুমিন বান্দার কল্যাণের জন্য সুপারিশ ও ক্ষমা প্রার্থনায় দোয়া করা ফেরেশতাদের বিশেষ কাজ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা দেন- ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে-

 رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ ‘রাব্বানা ওয়াসিতা কুল্লা শাইয়ির রাহমাতাও ওয়া ইলমাং ফাগফির লিল্লাজিনা তাবু ওয়ত্তাবাউ সাবিলাকা ওয়াক্বিহিম আজাবাল ঝাহিম।’ অর্থ: ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা মুমিন: ৭)

আমলনামা লেখার কাজ
কোরআনুল কারিমের অনেক আয়াত ও প্রিয়নবী (স.)-এর অনেক হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মানুষের সঙ্গেই তার সব ভালো-মন্দ লেখার জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। কোরআনুল কারিমে ‘কেরামান কাতিবিন বা সম্মানিত লেখকগণ’ হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেন- ‘যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে (মানুষ) যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সুরা ক্বাফ: ১৭-১৮)

জান কবজ ও আত্মা বহন করা
মালাকুল মউত ছাড়াও তাঁর সঙ্গে একদল ফেরেশতা রয়েছেন যারা জান কবজ ও আত্মা বহন করার কাজে নিয়োজিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা সাজদা:১১)

‘শপথ সে ফেরেশতাদের, যারা ডুব দিয়ে নির্মমভাবে আত্মা বের করে আনে এবং যারা মৃদুভাবে আত্মার বাঁধন খুলে দেয় এবং যারা তীব্র গতিতে চলাচল করে। আর যারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়। অতঃপর তারা সব কাজনির্বাহ করে।’ (সুরা নাজিয়াত: ১-৫)

আরও ইরশাদ হয়েছে ‘তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা সাজদা: ১১)

আরশ বহন করা
ফেরেশতাদের আট জনের একটি গ্রুপের কাজ হলো— মহান আল্লাহ তাআলার আরশ বহন করা। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের উর্ধ্বে বহন করবে।’ (সুরা হাক্বকাহ: ১৭)

এ ছাড়াও ফেরেশতারা নানা কাজ পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন। চাঁদ-সূর্যের জন্য, পাহাড়-পর্বতের জন্য, আকাশের বিভিন্ন স্থানের জন্য, মেঘ প্রবাহিত করার জন্য, বৃষ্টি বর্ষন করার জন্য, মায়ের গর্ভে ভ্রণের জন্য, জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, পাপীদের শাস্তি প্রদানের জন্য, জান্নাতিদের খেদমত ও শান্তির জন্যও অনেক ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছেন।

ফেরেশতারা পূর্ণ-তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত
ফেরেশতারা আল্লাহর ভয়ে বিনম্র হয়ে থাকেন। মূলত যে বান্দা আল্লাহ সম্পর্কে যতটুকু জানে সে আল্লাহকে ততটুকুই ভয় পায়। যেহেতু ফেরেশতারা আল্লাহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন, তাই তাঁরা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং তিনি যা আদেশ করেন তা পালন করে।’ (সুরা নাহল: ৫০)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যখন আল্লাহ আসমানে কোনো নির্দেশ জারি করেন, ফেরেশতারা আল্লাহর ভয়ে তাদের পাখা দিয়ে আঘাত করতে থাকে, যেভাবে পাথরের ওপর শিকল দিয়ে আঘাত করা হয়’ (সহিহ বুখারি: ৬৯৫৪)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহর ভয়ে বিনম্র।’ (সুরা আম্বিয়া: ২৮)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ফেরেশতাদের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখার, আল্লাহর অনুগত হওয়ার, ফরজ-মোস্তাহাব আমলগুলো যথাযথ সম্পন্ন করার এবং পূর্ণ তাকওয়ার গুণ অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর