শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আদমকন্যা আকলিমার বিয়ে ও পৃথিবীর প্রথম কোরবানির গল্প

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ মে ২০২৩, ০৪:৪৫ পিএম

শেয়ার করুন:

আদমকন্যা আকলিমার বিয়ে ও পৃথিবীর প্রথম কোরবানির গল্প

কোরবানির উৎপত্তি হিসেবে অনেকেই হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ঘটনা জানেন। মূলত কোরবানির ইতিহাস আরও প্রাচীন। পবিত্র কোরআন থেকে জানা যায়, আদিপিতা হজরত আদম (আ.)-এর আমলে তাঁর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল সর্বপ্রথম কোরবানি করেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন। (সুরা মায়িদা: ২৭)


বিজ্ঞাপন


বিস্তারিত ঘটনা
আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আসার পর থেকে তাঁদের বংশবিস্তার শুরু হয়। তখন হাওয়া (আ.)-এর গর্ভ থেকে জোড়াসন্তান অর্থাৎ প্রতিবার একটি ছিলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত (কেবল শীস আ. একা জন্মেছিলেন)। আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.) এর শরীয়তে এ নির্দেশ জারি করেন যে—

একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহনকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনি কন্যা সহোদরা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ।

আরও পড়ুন: জান্নাতি ফল মাথায় নিয়ে হুর আগমনের ঘটনা

সুতরাং সেসময় আদম (আ.) একটি মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। তার নাম ছিল লিওযা। বিয়ের সময় হলে শরয়ী নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহোদরা বোন কাবিলের জন্য নির্ধারিত হল আর হাবিলের জন্য নির্ধারিত হলো কাবিলের বোন আকলিমা। কিন্তু তাতে কাবিল রাজি হলো না। ফলে আদম (আ.) শরীয়তের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তাঁর নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে শাসন করলেন। তবুও সে এই শাসনে কান দিলো না।


বিজ্ঞাপন


অবশেষে আদম (আ.) হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি পেশ করো, যার কোরবানি গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেওয়া হবে।’ সেসময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কোরবানিকে ভস্মীভূত করে ফেলত। আর যার কোরবানি কবুল হত না, তারটা পড়ে থকত।

তাদের কোরবানির পদ্ধতি
কাবিল ছিল চাষি। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভালগুলো বের করে নিয়ে খারাপগুলোর একটি আটি কোরবানির জন্য পেশ করল। আর হাবিল ছিল পশুপালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট একটি দুম্বা কোরবানির জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিলো। (ফতহুল কাদিরের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হাবিলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে। অবশেষে ইসমাইল জাবিহুল্লাহ (আ.)-কে ওই দুম্বাটি পাঠিয়ে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।) আর কাবিলের কোরবানি যথাস্থানেই পড়ে থাকল।

অর্থাৎ হাবিলেরটি গৃহীত হলো আর কাবিলেরটি হলো না। কিন্তু কাবিল এ আসমানি সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল, এতে কাবিলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবিল বলেছিল—

‘তিনি মুত্তাকি কর্মই গ্রহণ করেন। সুতরাং তুমি তাকওয়ার কর্মই গ্রহণ করো। তুমি তাকওয়া অবলম্বন করলে তোমার কোরবানিও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কোরবানি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায়?…..তবুও এক পর্যায়ে কাবিল হাবিলকে হত্যা করে ফেলল। (তাফসির ইবনু কাসির, দুররে মনসুর, ফতহুল বায়ান: ৩/৪৫ ও ফতহুল কাদির: ২/২৮-২৯)

আরও পড়ুন: ইবলিস কোন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আদমকে সেজদা করেনি?

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হাবিল ও কাবিল কর্তৃক সম্পাদিত কোরবানির এ ঘটনা থেকেই মূলত কোরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কোরবানিদাতা ‘হাবিল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কোরবানি হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কোরবানি কবুল হয়। পক্ষান্তরে কাবিল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কোরবানি হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কোরবানি কবুল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো- কোরবানি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের ওপরে এটা জারি ছিল।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাকো এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।” (সুরা হজ:৩৪)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফি ও জামাখশারি বলেন, ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তাআলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসিরে নাসাফি: ৩/৭৯; কাশশাফ: ২/৩৩)

আদম (আ.)-এর যুগে তাঁরই পুত্র কাবিল ও হাবিলের কোরবানির পর থেকে ইব্রাহিম (আ.) পর্যন্ত কোরবানি চলতে থাকে। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরিয়ত নাজিল হয়েছে, প্রত্যেক শরিয়তের মধ্যে কোরবানির বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটি অপরিহার্য অংশ।

জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১৩ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানি করার সময় নির্ধারিত। মুসলমানগণ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করে থাকেন। কোরবানি করতে হবে সাধ্যের মধ্যে উৎকৃষ্ট পশু দিয়ে এবং তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশুদ্ধ নিয়তে সঠিক পদ্ধতিতে সুন্দর পশু কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর