মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

মোবাইল ব্যালেন্সের জাকাত দিতে হবে কি?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

মোবাইল ব্যালেন্সের জাকাত দিতে হবে কি?

জাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য জাকাতের বিকল্প নেই। জাকাত সম্পদ পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য মোচন করে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধুমাত্র সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু এবং ব্যবসার পণ্যের ওপর জাকাত ফরজ হয়। মোবাইল ব্যালেন্স কি ব্যবসায়িক পণ্য বা টাকা হিসেবে গণ্য হবে? অর্থাৎ এই ব্যালেন্সের কি জাকাত দিতে হবে? এই প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরই। বিশেষ করে রিচার্জ ব্যবসায়ীরা বিষয়টি জানতে চান।

এর উত্তর হলো—প্রিপেইড ব্যালেন্সের ওপর জাকাত আসবে না। কেননা তা টাকা নয়, মালও নয়। বরং তা নির্দিষ্ট একটি সেবা। অর্থাৎ প্রিপেইড ব্যালেন্সের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে ওই ব্যালেন্সের সমপরিমাণ সেবা পাওয়া যাবে। সুতরাং ব্যালেন্সে দৃশ্যমান টাকা যেহেতু টাকা নয়; বরং ক্রয়কৃত একটি সেবা পণ্য (যা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছে) তাই অন্যান্য সম্পদের মতো প্রিপেইড ব্যালেন্সের জাকাত দিতে হবে না।


বিজ্ঞাপন


তবে, রিচার্জ ব্যবসায়ীদের ব্যালেন্সে জাকাতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার দিন যা জমা থাকবে, সে টাকার জাকাত দিতে হবে। কেননা রিচার্জ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যালেন্সে অবস্থিত টাকা (অর্থাৎ সেবা) ব্যবসায়িক পণ্য। তাই অন্যান্য ব্যবসায়িক সম্পদের মতো ব্যালেন্সে থাকা সম্পদেরও জাকাত দিতে হবে। (হেদায়া: ১/১৮৬, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া ২/২৪৫, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৭২)

যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হবে না
১) সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ৬/৪৪৭-৪৪৮)

২) ঘরের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়, তা যত মূল্যবানই হোকনা কেন। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ১০৫৬০; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৯৩,৭১০২;আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৫) তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে যে, যেসব বস্তুর ওপর জাকাত আসে না— সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে, তাহলে অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও জাকাত ফরজ হবে।

৩) নিজ ও অধীনস্থ পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৫) 


বিজ্ঞাপন


৪) পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে জাকাত ফরজ হবে না। (রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৫)

৫) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য, ওসবের ওপর জাকাত ফরজ।

আরও পড়ুন:
জাকাত কি রমজানে দেওয়া বাধ্যতামূলক?
ইতেকাফের প্রস্তুতি: জরুরি মাসয়ালাগুলো জেনে নিন

৬) ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ। বর্তমানে ঘর-বাড়ি, গাড়ি বা দোকান ভাড়া নেওয়ার সময় মোটা অঙ্কের টাকা অ্যাডভান্স রাখতে হয়, অ্যাডভান্সের এই টাকা দোকানের মালিকের হয়ে যায় না। বরং যিনি ভাড়া নিচ্ছেন, তার মালিকানায় রয়ে যায়। তাই নিসাবের পরিমাণ হলে ওই টাকাসহ জাকাত দিতে হবে। দোকান বা বাড়ি গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ওই টাকার জাকাত আদায় করা জরুরি। (আদদুররুল মুখতার: ৩/১৮৪; ফতোয়ায়ে দারুল উলুম: ৬/৭৭, আহসানুল ফতোয়া: ৪/২৬১)

৭) ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।

যেসব সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ
১) সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।

২) সোনা-রুপার অলংকার সর্বদা বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক— সর্বাবস্থাতেই তার জাকাত দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৫; সুনানে নাসায়ি: ২২৫৮; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৫৪-৭০৬১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৯৯৭৪)

৩) অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৬১; ৭০৬৬; ৭১০২)

৪) জামা-কাপড় কিংবা অন্য কোনো সামগ্রীতে সোনা-রুপার কারুকাজ করা থাকলে  তা-ও জাকাতের  হিসাবের  অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যে পরিমাণ সোনা-রুপা কারুকাজে লেগেছে— অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে তারও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক: ৭০৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০৬৪৮-১০৬৪৯)

সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা ও মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (কিতাবুল আছার, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৬/৪৪৭-৪৪৮)

মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৯১-৭০৯২) তদ্রূপ ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ হয়।

৫) টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ হয়। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৭; রদ্দুল মুহতার: ২/২৬২-৩০০)

আরও পড়ুন: 
জাকাত অস্বীকারকারীর ভয়াবহ শাস্তি
সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন যেভাবে

৬) হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে— তা-ও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ  হলে এবং নিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে— জাকাত ফরজ হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৩২; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০৩২৫)

৭) দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ: ১/২১৮; সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ৪/১৫৭; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃষ্ঠা-১০৮; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক: ৭১০৩,৭১০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০৫৫৭, ১০৫৬০, ১০৫৬৩)

৮) ব্যবসার নিয়তে  কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর— যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি— তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭১০৩-৭১০৪)

৯) নিসাবের অতিরিক্ত সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা ও বাণিজ্যদ্রব্যের জাকাত আনুপাতিক হারে দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৩২-৭০৭৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৬/৩৯০; আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৯৯)

১০) কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরও কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল— তাহলে এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের জাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৬৮৭২, ৭০৪০-৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০৩২৫,১০৩২৭)

১১) বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে জাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে ওই সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর জাকাত আদায় করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৪২,৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার: ২/৩০২)

জাকাত না দেওয়ার শাস্তি
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুই পাশ কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসুলুল্লাহ (স.) তেলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য কেয়ামত দিবসে, অচিরেই অকল্যাণকর হবে, যা কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে।’ (বুখারি: ১৩২১)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে সম্পদের জাকাত দেওয়া হয়নি, তাকে বিষধর সাপে রূপান্তর করে ওই সম্পদের মালিকের গলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে এবং সাপটি তাকে ছোবল দিতে দিতে বলবে, আমি তোমার প্রিয় সম্পদ, গুপ্তধন।’ (বুখারি: ১৪০৩)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জাকাতের সহিহ বুঝ দান করুন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক খাতে সঠিক নিয়মে জাকাত দিয়ে অর্থ-সম্পদকে পবিত্র করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর