মানুষের অস্বাভাবিক দুর্ভোগ কমাতে বাজার দর স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের। যদিও বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ইসলামের সাধারণ নীতি হলো- পণ্য উৎপাদক পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। বিনা প্রয়োজনে শাসক কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ করাকে জুলুম বিবেচনা করতেন নবীজি (স.)। তিনি বলতেন, ‘..আমি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার জান ও মালের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে।’ (আবু দাউদ: ৩৪৫১)
তাছাড়া উৎপাদকের ধার্যকৃত মূল্যে হস্তক্ষেপ করলে উৎপাদক পণ্যের মান কমিয়ে দিতে পারে। যার ক্ষতি জনসাধারণের ওপর পড়বে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য যদি অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন লোভী সুবিধাভোগীদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য মূল্য নির্ধারণ করা জায়েজ।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না।’ (কিতাবুল মাজমু: ১২/১২১)
শায়খ তাহির বাদাভি বলেন, ‘বিনা প্রয়োজনে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা জুলুম। রাসুল (স.) জুলুমের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাজারে যখন অস্বাভাবিক কার্যকারণ অনুপ্রবেশ করবে যেমন—কতিপয় ব্যবসায়ীর পণ্য মজুদকরণ এবং তাদের মূল্য কারসাজি, তখন কতিপয় ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর সামষ্টিক স্বার্থ প্রাধান্য লাভ করবে। এ অবস্থায় সমাজের প্রয়োজনীয়তা বা চাহিদা পূরণার্থে এবং লোভী সুবিধাভোগীদের থেকে সমাজকে রক্ষাকল্পে মূল্য নির্ধারণ করা জায়েজ। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না দেওয়ার জন্য এ নীতি স্বতঃসিদ্ধ।’ (নিজামুল ইকতিসাদি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৭৮)
মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলামি শরিয়ত। প্রধান কারণগুলো হলো—
বিজ্ঞাপন
১) মজুদদারি: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ মজুদদারি। বাজারে পণ্য সংকট থাকার পরও ব্যক্তি মুনাফার জন্য পণ্য গুদামজাত করে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষত তা যদি খাদ্যশস্য হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৫৫)
২) বাজার সিন্ডিকেট: বাজার দর নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা অসাধু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট। ইসলামের নির্দেশনা হলো- পণ্য উৎপাদনের পর তা স্বাধীনভাবে বাজারে প্রবেশ করবে। বাজার মূল্য বৃদ্ধির জন্য তা আটকে রাখবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ২০৩৯৬)
আরও পড়ুন: পণ্য মজুদ করার ইহকালীন শাস্তি
৩) প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুবিধাগ্রহণ: আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য কিংবা তাদের কৃতকর্মের দরুন শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে অথবা গুনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর পথে ফিরে আসার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা প্রভৃতি নাজিল করেন। (সুরা সাজদাহ: ২১; সুরা বাকারা: ১৫৫; সুরা রুম: ৪১)। এমন পরিস্থিতিতে দ্রব্যসামগ্রী কম উৎপাদনের কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী এটিকে অধিক মুনাফা লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। অবাক করা ব্যাপার হলো- বন্যার অজুহাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য কিংবা বন্যাকবলিত এলাকার বাইরে যেসব পণ্য উৎপন্ন হয় সেগুলিরও দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। (সম্পাদকীয়, প্রথম আলো, ২৬শে জুলাই’১৯, পৃ-১০) বন্যার সময় বাংলাদেশের এটি চিরচেনা চিত্র। এই অবস্থায় কল্যাণকর ভূমিকা নিতে হবে ইসলামি রাষ্ট্রকে।
৪) কালো বাজারি: কালোবাজারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হয়। কালোবাজারি সরাসরি প্রতারণা, জুলুম ও আর্থিক অসততার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেরা নিজেদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
৫) মধ্যস্বত্বভোগী: মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারে না। ইসলাম পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণ পর্যন্ত মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী কারিম (স.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’ (সহিহ বুখারি: ২১৬৬)
আরও পড়ুন: নবী-রাসুলদের কার কী পেশা ছিল
৬) চাঁদাবাজি ও অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া: এটি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা যদি চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে, তারা এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়। তাছাড়া অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়ার ফলেও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। আর এর শিকার হন সাধারণ জনগণ। তাই চাঁদাবাজি ও অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ইসলামি রাষ্ট্রকেই। যারা পাপ কাজে সহযোগিতা করে তাদেরকেও দমন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন তারা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে। পাশাপাশি সেসব মানুষের পাপের বোঝাও বহন করবে, যাদের তারা অজ্ঞতাবশত বিভ্রান্ত করেছে। দেখো, তারা যা বহন করে, তা কতই না নিকৃষ্ট! (সুরা নাহল: ২৫)
৭) কৃষির প্রতি অমনোযোগ: কৃষিকাজে অমনোযোগের কারণে খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। ইসলাম কৃষি ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা জমিনের পরতে পরতে জীবিকা অন্বেষণ করো।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ)
এছাড়াও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে মুমিনরা নানাভাবে তা প্রতিহত করতে পারে। যেমন—
বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন: ব্যবসায়ীদের অন্যায় মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাজ বর্ধিত মূল্যের পণ্য বর্জন করতে পারে। কেননা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে গোশতের মূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা তাঁর কাছে অভিযোগ করে তার মূল্য নির্ধারণের দাবি জানায়। তিনি বলেন, তোমরাই এর মূল্য হ্রাস করে দাও। তাদের কাছ থেকে গোশত কেনা ছেড়ে দাও। (আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া: ৯/১৪১)
ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা: ব্যবসায়ীদের উচিত কঠিন সময়ে ক্রয়-বিক্রয়ে সহজতা অবলম্বন করা। এর বিনিময় জান্নাত। মহানবী (স.) বলেন, ‘আল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যে ক্রেতা, বিক্রেতা, বিচারক ও বিচারপ্রার্থী অবস্থায় সহজতা অবলম্বনকারী ছিল। (সুনানে নাসায়ি: ৪৬৯৬)
ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার শাস্তি। তাই পাপ পরিহার করা এবং তাওবা করে দ্বীনের পথে ফিরে আসা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পার্থিব জীবনের এই সংকট থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

