আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার মাপকাঠি হলো- সুন্নত অনুযায়ী জীবন যাপন করা। ‘সুন্নত’ অর্থ প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি, রীতি, আদর্শ ইত্যাদি। এক কথায় ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ইবাদত, লেনদেন ও শিষ্টাচারসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনাদর্শই হলো সুন্নত।
মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফেরাত ও জান্নাত লাভ করতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.) এর সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আদর্শের পরিপন্থী যাবতীয় আইন-বিধি, নীতি-আদর্শ, পথ-মত, জাহিলিয়াত ও নাফসানিয়াত পরিহার করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অপছন্দ করল তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (বুখারি: ৪৭৭৬)
বিজ্ঞাপন
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রাসুল (স.) তোমাদের যা আদেশ দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক’ (সূরা হাশর: ৭)। ‘যে ব্যক্তি রাসুলের (স.) আনুগত্য করল, সে যেন আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, আমি আপনাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রেরণ করিনি।’ (সুরা নিসা: ৮০)
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-কে যেভাবে অনুসরণ করতেন সাহাবিরা
রাসূলুল্লাহ (স.) এর সুন্নাহ আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে প্রিয়নবী (স.) নিজেই বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দু’টি জিনিস আঁকড়ে থাকবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ। (মুয়াত্তা মালেক: ৩৩৩৮)
এমনিভাবে পবিত্র কোরআনে সুন্নাহর অনুকরণ-অনুসরণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ কথাও বলা হয়েছে, কেউ যদি সুন্নাহর অনুসরণ না করে, তবে তার ঈমান যথাযথ হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে অর্থাৎ নবী (স.)-কে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে তা কবুল করে নেবে।’ (সুরা নিসা: ৬৫)
বিজ্ঞাপন
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে অন্য কোনো এখতিয়ার থাকে না। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (স.) আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। (সুরা আহজাব: ৩৬)
সুন্নতের অনুগামী হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা রয়েছে সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আদর্শ সেভাবেই অনুসরণ করতে হবে যেভাবে সাহাবায়ে কেরামগণ অনুসরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও আনসারদের অগ্রগামী দল আর যারা যথাযথভাবে তাদের অনুসারী, মহান আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও মহান আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত। তাঁরা সেখানে অনন্তকাল থাকবে। এটাই হলো মহান সফলতা।’ (সুরা তাওবা: ১০০)
আরও পড়ুন: কোরআনের ঘোষণায় যারা সফল
সুন্নতের গুরুত্ব বর্ণনায় ফাতহুল বারিতে ইমাম আবু দাউদ (রহ.) এর এক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। একদা তিনি নৌ-সফরকালীন একটি জাহাজে ছিলেন। তখন জাহাজ থেকে নদীর পার দিয়ে গমনকারী এক পথিককে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে শুনলেন। তিনি জাহাজ থেকে নেমে এক দিরহামের বিনিময়ে একটি নৌকা ভাড়া করে পারে এসে হাঁচিদাতার উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলে এলেন।
এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমি তার জবাবে গিয়ে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলায় সে প্রতি-উত্তরে ‘ইয়াহদিকুমুল্লাহ’ (আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত দিন) এ দোয়া করেছে, আর লোকটি হতে পারে এমন কেউ, যার দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়। তাহলে তো এটিই আমার সফলতার জন্য যথেষ্ট। অতঃপর ওই রাতে জাহাজের যাত্রীগণ স্বপ্নে দেখল, জনৈক ব্যক্তি ঘোষণা করছে, ‘নিশ্চয়ই আবু দাউদ এক দিরহামের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিয়েছে।’ (ফাতহুল বারি: ১০/৬১০-৬১১)
উল্লেখিত বর্ণনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে মুমিন জীবনে সুন্নতের গুরুত্ব অপরিসীম। আলেমগণ বলেন, আল্লাহর দরবারে আমল কবুল হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত: এক. আকিদা বিশুদ্ধ হওয়া, দুই. সুন্নতের অনুসরণ করা, তিন. নিয়ত সঠিক হওয়া।
মনে রাখতে হবে, সুন্নতের সঙ্গে বিদআতের সম্পর্ক নেই। ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের এ মর্মে অন্তিম উপদেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নত কঠোরভাবে অনুসরণ করবে। সাবধান! (দীনি বিষয়ে) নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা।’ (আবু দাউদ: ৪৬০৭)
আরও পড়ুন: ইসলাম পরিপূর্ণ দীন, বিদআত পরিত্যাজ্য
এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, ‘আমার সব উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে; কিন্তু যে অস্বীকার করবে। সাহাবিরা বললেন, কে অস্বীকার করবে? তিনি বলেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই অস্বীকার করবে।’ (বুখারি: ৭২৮০)
অতএব, মহানবী (স.)-এর জীবনকেই আদর্শ হিসেবে নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, তোমাদের মধ্যে যারা পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব বেশি করে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর জীবনে সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সুরা আহজাব: ২১)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (আলে ইমরান: ৩১)
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে জীবিত করল, সে আমাকেই ভালোবাসল, আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (তিরমিজি: ২৬৭৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নতের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।