‘স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ এই হাদিসের প্রকৃত অর্থ বা ব্যাখ্যা জানতে চান অনেকে। আমরা আগে এ সংক্রান্ত হাদিসটি দেখে নিই, এরপরে বিশদ আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হাদিসটি হলো- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ لَنْ تَسْتَقِيمَ لَكَ عَلَى طَرِيقَةٍ، فَإِنِ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَبِهَا عِوَجٌ، وَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهَا، كَسَرْتَهَا وَكَسْرُهَا طَلَاقُهَا হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, নারীকে পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে তোমার জন্য কখনোই সোজা হবে না। তাকে দিয়ে কাজ আদায় করতে হলে এই বাঁকা অবস্থায়ই আদায় করতে হবে। এটি সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে যাবে। ভাঙ্গার অর্থ হলো তালাক ঘটে যাওয়া। (সহিহ মুসলিম: ১৪৬৮)
বিজ্ঞাপন
হাদিসে এসেছে নারীকে স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কার পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করা হলো তা হাদিসে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং না বুঝার কারণে অনেকে মনে করতে পারেন যে সকল স্ত্রীকেই বুঝি নিজ নিজ স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এর কোনো ভিত্তি নেই।
হ্যাঁ, হাওয়া (আ.)-কে তাঁর স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথা সত্য। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ‘নফস’ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (সুরা নিসা: ১)
আরও পড়ুন: যারা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, তাদের সম্পর্কে নবীজি যা বলেছেন
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে কতিপয় মুফাসসির বলেন, ‘তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন’ বলে এখানে উদ্দেশ্য বিবি হাওয়া (আ.)। যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদম (আ.)-এর বাম পাঁজরের হাড় থেকে। তখন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। জাগ্রত হয়ে যখন তাকে দেখলেন, তখন বিস্মিত হলেন এবং তার প্রতি প্রীত হলেন। তিনিও আদম (আ.) এর প্রতি প্রীত হলেন। (তাফসির ইবনে কাসির: ২/২০৬; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা-৭৩১)
বিজ্ঞাপন
কিন্তু এর মানে এই নয় যে সকল স্ত্রীলোককে তার স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একে তো এর পক্ষে কোনো দলিল নেই, দ্বিতীয়ত এটি যুক্তিহীন কথা। কারণ, যে সকল মেয়ে বাচ্চা শিশুকালেই মারা গেছে বা বিয়ে ছাড়াই মারা গেছে, তাদের কার হাড় দিয়ে তৈরি করা হলো? তাদের তো স্বামীই ছিল না দুনিয়াতে। আর যেসব নারীর জীবনে একাধিক স্বামী এসেছে, তারা কোন স্বামীর পাঁজর থেকে সৃষ্টি হলো? সুতরাং স্বামীর পাঁজরের হাড় দিয়ে স্ত্রীদের তৈরি করা হয়েছে—এ দাবীটি ভুল।
আরও পড়ুন: সন্তানের জন্য পাঁচটি দোয়া করতে ভুলবেন না
তাহলে হাদিসটির ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যার আগে আরেকটি হাদিস দেখে নিই। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। কাজেই নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। (সহিহ বুখারি: ৩৩৩১)
এই হাদিসে নারীদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির কথা এসেছে ঠিক, কিন্তু বারবার বলা হচ্ছে, নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হতে। ইসলামি স্কলারদের মতে, স্বামীর পাঁজর সম্পর্কিত সবগুলো হাদিসের দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন-
১) এর অর্থ এই হতে পারে যে, এটি কেবলই একটি উপমা। এই উপমা নারীদেরকে উপলব্ধি করার জন্য, উত্তমভাবে বোঝার জন্য। পাঁজরের হাড়ের গঠন বাঁকা প্রকৃতির। নারী জাতির চিন্তা ভাবনাও পুরুষদের মতো নয় বরং কিছুটা ভিন্ন ধরণের। তারা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, কখনও অনেক কষ্ট পায়, আবার কখনও অনেক রাগ করে। তাই স্বামীদের উচিত নয়- স্ত্রীর কাছ থেকে সবকিছু নিখুঁত আশা করা। বরং উচিত হলো- তাদের ভুল ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে না ধরা। তাদের সঙ্গে ভালো ও সহনশীল আচরণ করা। এটিই হাদিসের মূল কথা।
আরও পড়ুন: কোরআনের বর্ণনায় নারীর ১০ বৈশিষ্ট্য
২) এর আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে যে নারীরা বাবা আদম (আ.)-এর পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি; স্বামীর পাঁজর থেকে নয়। (তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম: ১/১৩৭-১৩৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের সঠিক অর্থ অনুধাবন করার এবং নবীজির সুন্নত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

