রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রহস্যময় যে ঘটনায় গাভীর নামে সুরা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

রহস্যময় যে ঘটনায় গাভীর নামে সুরা

গাভীর আরবি প্রতিশব্দ বাকারা। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় সুরাটির নাম ‘সুরা বাকারা’। এটি মাদানি সুরা। বনী ইসরাইলের এক গাভীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এ সুরায়। এটি একটি আলামত ভিত্তিক নাম। অর্থাৎ এই সুরার নামকরণ ‘আল বাকারা’ হওয়ার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এটি এমন সুরা যেখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে। নিচে কোরআন ও হাদিসের আলোকে রহস্যপূর্ণ ঘটনাটি তুলে ধরা হলো—

মুসনাদ ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে, বনি ইসরাঈলের এক ধনী লোক—যার কোনো সন্তান ছিল না, তাঁর উত্তরাধিকারী ছিল এক ভ্রাতুষ্পুত্র। তাড়াতাড়ি সম্পত্তি লাভের আশায় সে চাচাকে হত্যা করে বসে। রাতে গ্রামের এক লোকের দরজার ওপরে রেখে আসে এবং সকালে গিয়ে ওই লোকটির ওপর হত্যার অপবাদ দেয়। অবশেষে দুই দলে বিভক্ত লোকদের মধ্যে মারামারি ও খুনাখুনির উপক্রম হয়। এমন সময় জ্ঞানী লোকেরা তাদেরকে বলেন- তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নবী মূসা (আ.) বিদ্যমান থাকতে একে অপরকে হত্যা করবে কেন? সুতরাং তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করে।


বিজ্ঞাপন


সূরা বাকারার ৬৭ থেকে ৭৩তম আয়াতে এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ বিবাদের মীমাংসার জন্যে বনী ইসরাইলের লোকেরা হযরত মূসা (আঃ)-এর শরণাপন্ন হলো। যেহেতু সাধারণ উপায়ে এ সমস্যার সামাধান করা সম্ভব ছিল না, তাই হযরত মূসা (আ.) অলৌকিক পন্থায় এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি বনী ইসরাইলীদের বললেন, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, একটি গরু জবাই করতে হবে। এরপর জবাই করা গরুর এক টুকরো গোশত নিহত ব্যক্তির গায়ে স্পর্শ করলে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম বলে দেবে। তারা এই নির্দেশ শুনে মূসা (আ.)কে বলল, এ ধরনের পরামর্শ দিয়ে তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো ? হযরত মূসা (আ.) জবাবে বললেন, ঠাট্টা বিদ্রূপ করা অজ্ঞ লোকদের কাজ। আল্লাহর নবীরা কখনও এমনটি করেন না। যদি হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে চাও তবে নির্দেশিত এই কাজ করতে হবে। এর বর্ণনা কোরআনে এসেছে এভাবে—

"স্মরণ কর যখন মূসা নিজের সম্প্রদায়কে বলেছিল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের একটি গরু জবাই করার আদেশ দিয়েছেন, তারা বলেছিল- তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছ? মূসা বলল, আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, যাতে মূর্খদের অন্তর্ভূক্ত না হই।" (সূরা বাকারা: ৬৭)

যখন ইহুদীরা বুঝতে পারলো যে, গরু জবাই করার আদেশ সত্য এবং অবশ্য পালনীয়, তখন তারা তালবাহানা শুরু করল এবং জানতে চাইল কোন ধরনের গরু জবাই করতে হবে? যদিও প্রশ্নের মাধ্যমে অনেক অস্পষ্টতা দূর হয়, কিন্তু ইহুদীরা এ ধরনের প্রশ্ন তুলে মূলত দায়িত্ব পালন না করার চেষ্টা করছিল। তাই তারা অভদ্রভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে।

"বনী ইসরাইলীরা মূসাকে বলেছিল, তুমি আমাদের জন্যে তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বল যে, তা কী রকম গরু? মূসা বলল, তিনি (আল্লাহ) বলেছেন, সেই গরু বৃদ্ধও নয়, অল্প বয়স্ক বা শাবকও নয়, বরং মধ্য বয়সী। অতএব তোমরা যেমন আদেশ পেয়েছ তেমনই পালন কর।" (সুরা বাকারা: ৬৮)

এবার অবাধ্য ইহুদিরা গরুর রঙ কেমন হবে জানতে চাইল। অথচ আল্লাহর প্রথম নির্দেশে গরুর কোনো নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ ছিল না। যদি রঙের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হত, তবে আল্লাহ প্রথম নির্দেশেই তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু আল্লাহ তাদের অজুহাত সৃষ্টির পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পরে নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ করে আয়াত নাজিল করেন। যে নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের কাজকে আরও কঠিন করে দিলেন।

"তারা বলল- তুমি আমাদের জন্যে তোমার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের গরুর রঙ কেমন তা বর্ণনা করেন। মুসা বললেন, তিনি ( আল্লাহ) বলেছেন, সেই গরুর বর্ণ গাঢ় হলুদ যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।" (সুরা বাকারা: ৬৯)

তারপর ইহুদিরা সেরকম গরু একটি লোকের কাছে পেলো। যা অন্য কারো কাছে ছিল না। লোকটি বলল, আল্লাহ তায়ালার শপথ! এই গরুর চামড়াপূর্ণ স্বর্ণের কম মূল্যে আমি বিক্রি করব না। সুতরাং তারা ওই মূল্যেই তা কিনে নেয় এবং জবাই করে।

তারপর তারা ওই জবাইকৃত গরুর একখণ্ড গোশত দিয়ে ওই মৃত ব্যক্তির ওপর আঘাত করে। তখন মৃত লোকটি দাঁড়িয়ে যায়। লোকগুলো তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে কে হত্যা করেছে? সে বলল- ‘আমার এই ভ্রাতুষ্পুত্র’। এ কথা বলেই সে মারা যায়। ফলে তাকে মৃত ব্যক্তির কোনো সম্পদ দেয়া হয়নি।

আল্লাহ ইচ্ছে করলে, অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে হত্যাকারীর নাম বা পরিচয় মূসা (আ.)কে বলে দিতে পারতেন, কিন্তু গরু জবাইয়ের ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ ইহুদীদের গরুভক্তি বা গরু পূজার প্রচলন ও এ ধরনের মানসিকতায় আঘাত করেন। একইভাবে মূসা (আ.)-এর মাধ্যমে একটি বড় বিবাদেরও নিষ্পত্তি ঘটান। গাভীর মালিককে নিয়েও আল্লাহর এক মহান কুদরত রয়েছে এখানে।

এ ঘটনার মাধ্যমে মূলত আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করলেন যে, ‘এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং স্বীয় নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম করো।’ সুতরাং আমাদের সব প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কর্ম আল্লাহ তায়ালা জানেন ও দেখেন। তাঁকেই ভয় করে আমাদের সব অপকর্ম বর্জন করা উচিত।

গাভীর মালিকের পরিচয় ও আল্লাহর হিকমত

বনি ইসরাইলের একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তার একটি গাভী ছিল। মারা যাওয়ার সময় তিনি তার স্ত্রীর কাছে শিশু সন্তানের জন্যে গাভীটি রেখে যান। ছেলেটি পিতার মৃত্যুর পর বড় হয়ে কাঠ বিক্রি করে সংসার চালাতো।

ছেলেটি তার কাঠ বিক্রির টাকা তিনভাগে ভাগ করতো— এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য, এক তৃতীয়াংশ মায়ের জন্যে খরচ করতো এবং বাকী এক তৃতীয়াংশ দান-খয়রাত করতো।

অনুরূপভাবে রাতকে তিনভাগে ভাগ করতো ছেলেটি—একভাগ ঘুমাতো। একভাগ মায়ের খেদমত করতো। আরেকভাগ আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করতো। ছেলেটি বড় হলে তার মা তাঁকে বললেন—

তোমার বাবা মিরাসস্বরূপ তোমার জন্যে একটি গাভী রেখে গেছে। সেটি মাঠে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হচ্ছে। তুমি মাঠে গিয়ে এই বলে আওয়াজ দাও যে, হে ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক ও ইয়াকুবের প্রভু! গাভী প্রদান করুন! গাভীর নিদর্শন হলো- তা হবে গাঢ় হলুদ বর্ণের খুবই চমৎকার গাভী।

যুবক মাঠে গিয়ে দেখলো গাভীটি জমিনে বিচরণ করছে এবং মায়ের নির্দেশ পালন করার সঙ্গে সঙ্গে গাভীটি তার সামনে চলে আসে। দেখা গেল—মায়ের বর্ণিত নিদর্শন ও গুণাবলী গাভীর মাঝে রয়েছে।

যুবক যখন গাভীর ঘাড় ধরে টানতে থাকে তখন গাভী বলল, হে মায়ের বাধ্য সন্তান! তুমি আমার উপর আরোহন কর, তোমার আরাম হবে। যুবক বলল, আমার মায়ের নির্দেশ হলো, তোমার গর্দান ধরে নিয়ে যাওয়া, আরোহন করা নিষেধ আছে।

তখন গাভী বলল, হে যুবক! তুমি যদি আমার কথামতো আমার উপর আরোহন করতে, তবে আমি কখনো তোমার বাধ্য হতাম না। তোমার মায়ের আনুগত্যের কারণে তোমার এ মর্তবা হাসিল হয়েছে যে, তুমি যদি পাহাড়কেও নির্দেশ দাও, সেও চলতে শুরু করবে।

এবার যুবক গাভী নিয়ে মায়েরে কাছে চলে যায়। মা তাকে বলে, তুমিতো গরীব। দিনে কাঠ সংগ্রহ করো আর রাতের বেলা ইবাদাত-বন্দেগি করো। এতে তোমার প্রচুর পরিশ্রম ও কষ্ট হয়। তাই ভালো মনে করছি, তুমি এটি বিক্রি করে ফেল।

ছেলে জিজ্ঞাস করে, কত দামে বিক্রি করবো? মা তাকে তৎকালীন বাজার মূল্য তিন দিরহামে বিক্রির নির্দেশ দেয় এবং বলে যে বিক্রির পূর্ব মুহূর্তে ফের আমার কাছে জেনে নিবে। যুবক মায়ের নির্দেশ মোতাবেক গাভীটি বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা যুবকের মাতৃভক্তির পরীক্ষার জন্য ফেরেশতা প্রেরণ করলেন, ফেরেশতা গাভীর দাম জিজ্ঞাস করতেই যুবক তিন দিরহাম দাম চায় এবং বলে শর্ত হলো আমার মাকে জিজ্ঞেস করে বিক্রি করবো। ফেরেশতা বললেন, ছয় দিরহামের বিনিময়ে আমার কাছে গাভীটি বিক্রি করে দাও। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। যুবক বলল, তুমি যদি গাভীর সমপরিমাণ স্বর্ণও আমাকে দাও, তবু আমি মায়ের অনুমতি ছাড়া গাভী বিক্রি করবো না। এ কথা বলে যুবক মায়ের কাছে গমন করলো এবং ঘটনা বর্ণনা করলো।

মা যুবককে জানালেন, উনি তো ক্রেতা নন, বরং ফেরেশতা, তোমার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এসেছেন। বরং তাকে জিজ্ঞেস করো আমরা এ গাভীটি বিক্রি করবো কিনা?

যুবক ফেরেশতার নিকট গাভীটি বিক্রির ব্যাপারে পরমর্শ চাইলে ফেরেশতা বললেন, এখনই তা বিক্রি করো না। অতঃপর ফেরেশতা বনি ইসরাইলের নিহত ব্যক্তি ও হজরত মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে তাঁদের সম্পূর্ণ ঘটনা যুবক জানিয়ে বললেন, এখনই গাভী বিক্রির প্রয়োজন নেই। গাভী নিয়ে বাড়ি চলে যাও।

বনি ইসরাইলের লোকেরা যখন এ গাভী দেখবে তখন তারা এটিকে খরিদ করে নিবে। তুমি তাদের নিকট গাভীর চামড়া পরিপূর্ণ স্বর্ণ-মুদ্রার বিনিময়ে গাভীটি বিক্রি করবে।

ওদিকে বনি ইসরাইলের উপর যুবকের নিকট থাকা এমন একটি গাভী জবাইয়ের নির্দেশ হলো। তাঁরা গাভী খুঁজতে খুঁজতে যুবকের নিকট চাহিদা মোতাবেক গাভীটি পেল। অবশেষে যুবকের নিকট থেকে তারা গাভীটি পরিপূর্ণ চামড়া ভর্তি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে গাভীটি খরিদ করে নেয়।

গাভীর ঘটনা আল্লাহ তাআলার কুদরতের মহা নির্দশন। তিনি তাঁর অনুগত অস্বচ্ছল যুবককে এ গাভী বিক্রি অর্থ দ্বারা স্বচ্ছলতা দান করেছেন, আবার বনি ইসরাইলের মৃত ব্যক্তির হত্যাকারীও শনাক্ত করেছেন।

আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এভাবেই হিকমত দ্বারা সাহায্য করে থাকেন। মুসলিম উম্মাহকে তিনি ইসলামি নির্দেশনার প্রতি অবাধ্য মানসিকতা পরিহার করার এবং তাঁর নির্দেশ যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএ/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর