অনুবাদ দেখে কোরআনের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা যায় না। যদি আরবি ভাষারীতি অনুসারে কোরআনের অর্থ অনুধাবন না করা হয়, ভুল ব্যাখ্যার কারণে মুসলিম উম্মাহ বিভ্রান্ত হবে। সমাজে মতানৈক্য দেখা দেবে। এজন্য পূর্বসূরি আলেমরা কোরআনের ব্যাখ্যায় মানুষকে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ ‘তাবিল’ (ব্যাখ্যা) ও ‘কিয়াস’ (যুক্তি বা অনুমান)-এর ক্ষেত্রে ভুল করে। তারা ব্যাখ্যার ভুল করে কোরআন সুন্নাহর ক্ষেত্রে, আর অনুমানের ভুল করে যুক্তির ক্ষেত্রে।’ (মাজমুউল ফতোয়া: ৩/৬৩)
আল্লামা ইবনে জারির তাবারি (রহ.) বলেন, ‘মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর কিতাবের অর্থ আরবদের ভাষার অনুকূল হওয়া আবশ্যক। কেননা কোরআনের ভাষাকে তাদের উপযোগী করা হয়েছে। তাদের ভাষাকে সব ভাষার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে।’ (তাফসিরে তাবারি: ১/১২)
বিজ্ঞাপন
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘(কোরআনে) যে ভাষার মাধ্যমে সম্বোধন করা হয়েছে তা ভাষাগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ এবং বক্তব্য প্রকাশে সবচেয়ে বেশি সুস্পষ্ট। এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘আমিই অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কোরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: ২; দরউ তাআরুজিল আকলি ওয়ান-নাকলি: ৫/৩৭৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘(কোরআন) অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে অবশ্যই এর উল্লেখ আছে’ (সুরা আশ-শুআরা: ১৯৫-১৯৬)। ‘..আমিই অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কোরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: ২)
উল্লিখিত আয়াতদ্বয় থেকে বোঝা যায়, কোরআনের মর্মার্থ বুঝতে হবে আরবি ভাষারীতির আলোকেই। মনে রাখতে হবে, মক্কার লোকেরাও আরবি ভাষা বুঝত। কিন্তু তাদের কাছে কোরআন ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা এর আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪)
এ আয়াতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রধান চারটি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। ১) তিনি কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাবেন। ২) তিনি উম্মতের আত্মশোধন করবেন। ৩) তিনি কিতাব তথা কোরআনের ব্যাখ্যা দেবেন। ৪) তিনি হেকমত শিক্ষা দেবেন। এ আয়াত থেকে জানা যায়, সর্বসাধারণের জন্য ব্যাখ্যা ছাড়া কোরআন বোঝা সম্ভব নয়, যদিও তারা আরবি ভাষাগত জ্ঞান লাভ করে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত পড়াশোনায় কোরআনের মর্ম উপলব্ধি সর্বসাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথা আরবি ভাষাভাষী বা অনারবি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বিজ্ঞাপন
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন, ‘সঠিকভাবে কোরআন মাজিদের অর্থ ও তাফসির বোঝার জন্য ১৫ ধরনের জ্ঞানে পারদর্শী হতে হয়। যথা—ইলমে সরফ (আরবি শব্দপ্রণালী)। ইলমে ইশতিকাক (আরবি শব্দের ধাতুগত ও অর্থগত ব্যবহার)। ইলমুন নাহু (আরবি বাক্যপ্রণালী)। ইলমুল বায়ান (আরবি বাক্যের স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতা এবং তুলনা ও ইশারা)। ইলমে বাদি (আরবি বাক্যের সৌন্দর্যপ্রণালী)। ইলমে মা’আনি (বাক্যের পারস্পরিক সস্পর্ক ও সময়ের চাহিদাবিষয়ক জ্ঞান)। ইলমে আকায়েদ (ইসলামি আকিদা ও বিশ্বাসের জ্ঞান)
ইলমুল কিরাত (বিভিন্ন কেরাতের শব্দ ও অর্থগত তারতম্য)। ইলমু উসুলিদ্দীন (ইসলামের মূলনীতি)। ইলমু উসুলিল ফিকহ (ইসলামি আইনের মূলনীতি)। আসবাবে নুজুল (কোরআন অবতরণের প্রেক্ষাপট)। কাসাস বা ঘটনাবলি। নাসেখ ও মানসুখ (রহিতকারী ও রহিত আয়াতের জ্ঞান)। ইলমে ফিকহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র)। ইলমুল হাদিস (হাদিসশাস্ত্র)। ইলমে লাদুনি (আল্লাহ প্রদত্ত ইলম)। এসব জ্ঞান কোরআনের অনুবাদ ও তাফসিরের জন্য অপরিহার্য। এসব জ্ঞানে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন ছাড়া কেউ কোরআনের অনুবাদ বা তাফসির করলে তা হবে ‘তাফসির বির রায়’ তথা মনগড়া ও বিভ্রান্তিমূলক তাফসির। (রূহুল মাআনী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৬-৭)
আধুনিক যুগে ‘উলুমুল কোরআন’ বিষয়ে বহুল পঠিত গ্রন্থ হলো ‘মাবাহেস ফি উলুমিল কোরআন’। এটি লিখেছেন ড. মান্নাউল কাত্তান। তাঁর মতে, কোরআনের তাফসিরের জন্য তাফসিরকারকের মধ্যে সাতটি গুণ থাকা অপরিহার্য। ১. বিশুদ্ধ আকিদা ও বিশ্বাসের অধিকারী হওয়া। ২. কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে মুক্ত হওয়া—অর্থাৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোরআনের অনুবাদ বা তাফসির না করা। ৩. প্রথমে কোরআনের ব্যাখ্যা কোরআনের অন্য আয়াতের সাহায্যে উপস্থাপনের চেষ্টা করা। ৪. কোরআনের ব্যাখ্যায় হাদিসের বক্তব্য খোঁজ করা এবং হাদিসের বর্ণনা মোতাবেক অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করা। ৫. কোরআন ও হাদিস থেকে কোরআনের কোনো শব্দের বা আয়াতের মর্ম উদ্ঘাটনে সক্ষম না হলে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। ৬. কোরআনের কোনো শব্দ বা আয়াতের ব্যাখ্যা কোরআনের অন্য আয়াত, হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হলে তাবেয়িদের বর্ণনা গ্রহণ করা। ৭. আরবি ভাষা ও এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হওয়া। (মান্নাউল কাত্তান, ‘মাবাহেস ফি উলুমিল কোরআন’, মাকতাবাতু ওহাবা, কায়রো, মিসর, পৃষ্ঠা: ৩২১-৩২২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে হেফাজত করুন। অনুবাদভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।