পবিত্র কোরআন হিফজ করার তাওফিক আল্লাহর অনন্য নেয়ামত। যে নেয়ামতের ব্যাপারে ঈর্ষা করাও জায়েজ। রাসুল (স.) বলেছেন, দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঈর্ষা করা যায় না। এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং সে তা দিন-রাত তেলাওয়াত করে। আর তা শুনে তার প্রতিবেশীরা বলে, হায়! আমাদের যদি এমন জ্ঞান দেওয়া হতো, যেমন অমুককে দেওয়া হয়েছে, তাহলে আমিও তার মতো আমল করতাম। অন্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে সত্য ও ন্যায়ের পথে সম্পদ খরচ করে। এ অবস্থা দেখে অন্য এক ব্যক্তি বলে, হায়! আমাকে যদি অমুক ব্যক্তির মতো সম্পদ দেওয়া হতো, তাহলে সে যেমন ব্যয় করছে, আমিও তেমন ব্যয় করতাম।’ (বুখারি: ৫০২৬)
নিচে নবীজির ভাষ্য অনুযায়ী, কোরআনের হাফেজদের অনন্য মর্যাদা তুলে ধরা হলো—
বিজ্ঞাপন
আল্লাহর পরিজন
হাফেজে কোরআন সম্মানিত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতকারীদের ব্যাপারে নবীজি (স.) জানিয়েছেন, তারা আল্লাহর পরিজন। আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, কিছু মানুষ আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তেলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫)
একজন হাফেজ অনেক বেশি কোরআন তেলাওয়াতের কারণেই হাফেজ হন। এর জন্য হাজার হাজার ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াতে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার হাফেজ হওয়ার পরও হেফজ ধরে রাখার জন্য তাদের অনেক বেশি পরিমাণে তেলাওয়াত করতে হয়।
সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা
পবিত্র কোরআন হিফজ করা, চর্চা করা এতটাই ফজিলতপূর্ণ কাজ যে, রাসুল (স.) তার হিফজকারীদের ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেছেন, কোরআনের হাফেজ পাঠক লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতাদের মতো। খুব কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কোরআন পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারি: ৪৯৩৭)
বিশেষ সংবর্ধনা
দুনিয়াতে যারা কোরআন শিখবে সে মতে আমল করবে, হিফজ করবে, কিয়ামতের দিন তাদের বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, কোরআন কেয়ামত দিবসে হাজির হয়ে বলবে, হে আমার প্রভু, একে (কোরআনের বাহককে) অলংকার পরিয়ে দিন। তারপর তাকে সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তাকে আরো পোশাক দিন। সুতরাং তাকে মর্যাদার পোশাক পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। কাজেই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি একেক আয়াত পাঠ করতে থাকো এবং ওপরের দিকে উঠতে থাকো। এমনিভাবে প্রতি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব (মর্যাদা) বাড়ানো হবে। (তিরমিজি: ২৯১৫)
বিজ্ঞাপন
তাঁদের মা-বাবাকেও সম্মাননা
সাহল ইবনু মুআজ আল-জুহানি (রহ.) থেকে তার পিতা থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তা অনুযায়ী আমল করে, কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল হবে। ধরে নাও, যদি সূর্য তোমাদের ঘরে বিদ্যমান থাকে (তাহলে তার আলো কিরূপ হবে?)। তাহলে যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারটি কেমন হবে, তোমরা ধারণা করো তো!’ (আবু দাউদ: ১৪৫৩; শুআবুল ঈমান: ১৭৯৭)
কোরআনের ধারকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ
নবীজি (স.) সাহাবায়ে কেরামকে কোরআনের ধারক-বাহকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। যারা ৩০ পারা কোরআন হেফজ করে তা ধরে রাখে, তার ওপর আমল করে, তারাও সেই সম্মানের যোগ্য। আবু মুসা আল-আশআরি (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ: ৪৮৪৩)
কোরআন কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
দুনিয়ায় যারা কোরআন চর্চা করবে, মহান আল্লাহর হুকুমে কেয়ামতের দিন পবিত্র কোরআন তাদের জন্য সুপারিশ করবে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘সিয়াম এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম (রোজা) বলবে, হে রব, আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মেটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ কবুল করো। কোরআন বলবে, হে রব, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।’ (শুআবুল ঈমান: ১৮৩৯)
কোরআনের ধারক এবং তাঁর সুপারিশে আরও ১০ জন জান্নাতে যাবেন
আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবীজি (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে ও মুখস্থ করে, এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনে চলে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার পরিবারের এমন ১০ ব্যক্তির জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের প্রত্যেকেরই জাহান্নাম চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল।’ (আহমদ: ১২৬৮; তিরমিজি: ২৯০৫; ইবনু মাজাহ: ২১৬; শুয়াবুল ঈমান: ১৭৯৬; মেশকাত: ২১৪১) ইমাম তিরমিজি বলেছেন, হাদিসটি গরিব।
কোরআন শিক্ষা সম্পদ অর্জনের চেয়ে উত্তম
উকবাহ ইবনে আমির (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) এলেন। তখন আমরা সুফফাহ বা মসজিদের চত্বরে অবস্থান করছিলাম। তিনি বলেন, তোমরা কেউ চাও যে, প্রতিদিন বুত্বহান বা আকিকের বাজারে যাবে এবং সেখান থেকে কোনো পাপ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়াই বড় কুঁজ বা চুঁটিবিশিষ্ট দুটি উটনি নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা এরূপ চাই। তিনি বলেন, তাহলে কি তোমরা কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দুটি আয়াত শিক্ষা দেবে না কিংবা পাঠ করবে না? এটা তার জন্য ওইরূপ দুটি উটনির চেয়েও উত্তম। এমনিভাবে তিনটি আয়াত তিনটি উটনির চেয়ে উত্তম এবং চারটি আয়াত চারটি উটনির চেয়েও উত্তম। আর অনুরূপ সমসংখ্যক উটনির চেয়ে তত সংখ্যক আয়াত উত্তম। (মুসলিম: ১৭৫৮)
অতএব, আমাদের উচিত, সম্ভব হলে কোরআন হেফজ শুরু করা। তা সম্ভব না হলে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা, আর পরবর্তী প্রজন্মকে কোরআনে হাফেজ বানানোর চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।