মানবজাতির জন্য দুটি পরিণাম। জান্নাত অথবা জাহান্নাম। ঈমানদারদের মধ্যে পাপের শাস্তি হিসেবে প্রাথমিকভাবে কেউ জাহান্নামে যাবে। কেউ সরাসরি প্রবেশ করবেন জান্নাতে। যেসব ঈমানদার পাপের কারণে প্রথমে জাহান্নামে যাবে, তাদেরকে ঈমানের কারণে আবার স্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তাদের মধ্য থেকে সর্বশেষ যে ব্যক্তি চিরসুখের জান্নাতে প্রবেশ করবেন— তাঁর জান্নাতে প্রবেশের ঘটনাটি খুবই মজার। হাদিসে কুদসিতে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। নিচে তা তুলে ধরা হলো।
ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে , রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশ করবে এমন ব্যক্তি— যে একবার চলবে, একবার হোঁচট খাবে; একবার আগুন তাকে ঝলসে দেবে। যখন সে তা অতিক্রম করবে তার দিকে ফিরে তাকাবে। অতঃপর বলবে- বরকতময় সেই সত্ত্বা! যিনি আমাকে তোমার থেকে নাজাত দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে এমন বস্তু দান করেছেন— যা পূর্বাপর কাউকে দান করেননি।
বিজ্ঞাপন
অতঃপর তার জন্য একটি গাছ প্রকাশ করা হবে, সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে এ গাছের নিকটবর্তী করুন, যেন তার ছায়া গ্রহণ করতে পারি ও তার পানি পান করতে পারি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে আদম সন্তান! যদি আমি তোমাকে এটা দান করি— হয়তো অন্য কিছু তলব করবে। সে বলবে- না, হে আমার রব।
এ সময় সে ওয়াদা দেবে যে, এ ছাড়া কিছু তলব করবে না। তখন আল্লাহ তাকে ছাড় দেবেন। কারণ সে এমন কিছু দেখবে যার ওপর তার ধৈর্যধারণ করা সম্ভব হবে না। তাকে তার (গাছের) নিকটবর্তী করবেন, ফলে সে তার ছায়া গ্রহণ করবে ও তার পানি পান করবে। অতঃপর তার জন্য অপর গাছ প্রকাশ করা হবে, যা পূর্বের তুলনায় বেশি সুন্দর। সে বলবে- হে আমার রব, আমাকে এর নিকটবর্তী করুন, যেন তার পানি পান করতে পারি ও তার ছায়া গ্রহণ করতে পারি, এ ছাড়া কিছু চাইব না।
তিনি (আল্লাহ তাআলা) বলবেন, হে আদমসন্তান তুমি কি আমাকে ওয়াদা দাওনি যে, অন্য কিছু চাইবে না? আমি যদি তোমাকে এর নিকটবর্তী করি হয়তো (আবারও) অন্য কিছু চাইবে। ফলে সে ওয়াদা দেবে যে, অন্য কিছু চাইবে না, তার রব তাকে ছাড় দেবেন। কারণ সে এমন কিছু দেখবে যার ওপর তার ধৈর্য নেই। অতঃপর তাকে তার (দ্বিতীয় গাছের) নিকটবর্তী করবেন, সে তার ছায়া গ্রহণ করবে ও তার পানি পান করবে।
অতঃপর তার সামনে প্রকাশ করা হবে আরেকটি গাছ জান্নাতের দরজার মুখে, যা পূর্বের দুইটি গাছের চেয়ে বেশি সুন্দর। সে বলবে- হে আমার রব! আমাকে এ গাছের নিকটবর্তী করুন। আমি তার ছায়া গ্রহণ করব ও তার পানি পান করব। এ ছাড়া কিছু চাইব না। তিনি (আল্লাহ তাআলা) বলবেন, হে আদমসন্তান তুমি কি আমাকে ওয়াদা দাওনি যে, অন্য কিছু চাইবে না? সে বলবে- অবশ্যই হে আমার রব, এটাই চাই; আর কিছু চাইব না, তার রব তাকে ছাড় দেবেন। কারণ সে এমন কিছু দেখবে— যার ওপর তার ধৈর্য নেই। অতঃপর তিনি তাকে তার নিকটবর্তী করবেন, যখন তার নিকটবর্তী করা হবে— সে জান্নাতিদের আওয়াজ শুনবে। সে বলবে- হে আমার রব! আমাকে তাতে প্রবেশ করান। তিনি (আল্লাহ তাআলা) বলবেন, হে বনি আদম, কীসে তোমার থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দেবে? তুমি কি সন্তুষ্ট যে, আমি তোমাকে দুনিয়া ও তার সাথে তার সমান দান করি? (অর্থাৎ দুনিয়ার দ্বিগুণ দিলেই কি তুমি খুশি হবে?) সে বলবে- হে আমার রব! আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন অথচ আপনি উভয় জাহানের রব?
বিজ্ঞাপন
ইবনে মাসউদ হেসে দিয়ে বলেন, তোমরা আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছ না যে, আমি হাসছি কেন? তারা বলল- কেন হাসছেন? তিনি বললেন- রাসুল (স.) (হাদিসটি বর্ণনা করার সময়) এরূপ হেসেছেন। তখন তারা (সাহাবিরা) বলল, হে আল্লাহর রাসুল কেন হাসছেন? তিনি বললেন, আল্লাহর হাসি থেকে যখন সে বলল, আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন অথচ আপনি উভয় জাহানের রব? তিনি বললেন, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না, তবে আমি যা চাই— করতে পারি। (মুসলিম, হাদিসে কুদসি: ৫৫)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘...আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ফয়সালা থেকে ফারেগ হবেন। শুধু এক ব্যক্তি জাহান্নামের ওপর তার চেহারা দিয়ে অগ্রসর হতে থাকবে। সে-ই হবে জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ জাহান্নামী। সে বলবে- হে আমার রব, আমার চেহারা জাহান্নাম থেকে ঘুরিয়ে দিন। কারণ সে (জাহান্নাম) আমার চেহারা বিষাক্ত করে দিয়েছে। তার লেলিহান আমাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
অতঃপর সে আল্লাহর নিকট দোয়া করবে, আল্লাহ যেভাবে তার দোয়া পছন্দ করবেন। অতঃপর আল্লাহ বলবেন- এমন হবে না তো, যদি তোমাকে তা দান কবি, তুমি অন্য কিছু চেয়ে বসবে? সে বলবে- না, তোমার ইজ্জতের কসম। এ ছাড়া আপনার নিকট কিছু চাইব না।
সে তার রবকে যা ইচ্ছা ওয়াদা ও অঙ্গিকার দেবে। ফলে আল্লাহ তার চেহারা জাহান্নাম থেকে ঘুরিয়ে দেবেন। অতঃপর সে যখন জান্নাতের দিকে মুখ করবে ও তা দেখবে, চুপ থাকবে— আল্লাহ যতক্ষণ তার চুপ থাকা চান। অতঃপর বলবে, হে আমার রব আমাকে জান্নাতের দরজা পর্যন্ত অগ্রসর করুন।
আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি কি আমাকে ওয়াদা দাওনি যে, আমি তোমাকে যা দিয়েছি তা ছাড়া অন্য কিছু কখনো চাইবে না? হে বনি আদম সর্বনাশ তোমার, তুমি খুব ওয়াদা ভঙ্গকারী। সে ‘হে আমার রব’ বলবে, পাশাপাশি আল্লাহকে ডাকবে। অবশেষে আল্লাহ বলবেন, এমন হবে না তো, যদি তা দেই অপর বস্তু চাইবে? সে বলবে- না, তোমার ইজ্জতের কসম তা ছাড়া কিছু চাইব না। যত ইচ্ছা ওয়াদা ও অঙ্গিকার প্রদান করবে সে। ফলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের দরজার নিকটবর্তী করবেন।
যখন সে জান্নাতের দরজার নিকট দাঁড়াবে, তার জন্য জান্নাত উন্মুক্ত হবে। সে তার নেয়ামত ও আনন্দ দেখতে পাবে। অতঃপর চুপ থাকবে— আল্লাহ যতক্ষণ তার চুপ থাকা চান। এরপর বলবে- হে আমার রব! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আল্লাহ বলবেন- তুমি কি ওয়াদা ও অঙ্গিকার দাওনি যে, আমি যা দিয়েছি তা ছাড়া কিছু চাইবে না? তিনি বলবেন, হে বনি আদম সর্বনাশ তোমার। তুমি অতি ওয়াদা ভঙ্গকারী। সে বলবে- হে আমার রব! আমি তোমার হতভাগা মখলুক হতে চাই না। সে ডাকতে থাকবে, অবশেষে তার কারণে আল্লাহ হাসবেন। হাসতে হাসতে তাকে বলবেন, জান্নাতে প্রবেশ করো। যখন সে তাতে প্রবেশ করবে, আল্লাহ তাকে বলবেন- চাও, সে চাইবে ও প্রার্থনা করবে। এমনকি আল্লাহও তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন— এটা, ওটা। অবশেষে যখন তার আশা শেষ হয়ে যাবে, আল্লাহ বলবেন, এগুলো তোমার জন্য এবং এর অনুরূপও তার সাথে।
আতা ইবনে ইয়াজিদ বলেন, আবু সায়িদ খুদরি আবু হুরায়রার সঙ্গেই ছিল। আবু হুরায়রা (রা.) হাদিসের কোনো অংশ তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি। অবশেষে যখন আবু হুরায়রা বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “এগুলো তোমার জন্য এবং এর সমান এর সাথে।” আবু সায়িদ খুদরি বললেন, ‘এবং তার সাথে তার দশগুণ হে আবু হুরায়রা।’
আবু হুরায়রা বললেন, আমার শুধু মনে আছে- ‘এগুলো এবং এর সাথে তার অনুরূপ।’ আবু সায়িদ বললেন, সাক্ষী দিচ্ছি আমি রাসুল (স.) থেকে তার বাণী— ‘এগুলো তোমার জন্য এবং তার সমান দশগুণ’— খুব ভাল করে স্মরণ রেখেছি। আবু হুরায়রা বললেন, এই ব্যক্তি হলো- জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি।’ (বুখারি, হাদিসে কুদসি: ৫৬)

