মুমিনের জীবনে আল্লাহু আকবর ধ্বনির চেয়ে বড় কোনো ধ্বনি নেই। আল্লাহু আকবর অর্থ—আল্লাহ মহান। এই তাকবির উচ্চারণের মাধ্যমে মূলত আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। শক্তি-সামর্থ-সম্মান সবদিক থেকে মহান আল্লাহ সবার ঊর্ধ্বে— তাকবির সে অর্থেরই প্রতীক।
হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘আল্লাহু আকবর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বাক্য’ (তাফসিরে কুরতুবি)। এ ধ্বনি প্রকাশে উৎসাহিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি পূর্ণরূপে তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করো’ (সুরা ইসরা: ১১১)
বিজ্ঞাপন
কারো অন্তরে তাকবিরের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব যত বেশি হবে, তার ঈমানের প্রভাব তত বেশি প্রতিফলিত হবে। তাই ইসলামী শরিয়তে আজান ও নামাজের পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় ও জীবনঘনিষ্ঠ নানা অনুষঙ্গে তাকবির পাঠের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
জন্মের পর থেকে আল্লাহু আকবর ধ্বনি শুনে বড় হন উম্মতে মুহাম্মদী। নবজাতকের কানে তাকবির। আজান ও নামাজে তাকবির। চাঁদ দেখার সময়, হজের সময়, কাবা জিয়ারতকালে তাকবির। কঙ্কর নিক্ষেপ করার সময়, আরোহণ করার সময়, তাওয়াফ করাসহ এ ধরনের সব জায়গাতেই আল্লাহু আকবর বলতে হয়।
জিলহজের ১০ দিন আল্লাহর কাছে তাকবিরের চেয়ে আর বড় কোনো আমল নেই। (মুসনাদে আহমদ: ৬১৫৪)
এছাড়াও দুই ঈদে, পশু-পাখি জবাইয়ে, সফরে, বাহনে আরোহনে, উপরে উঠার সময়, এমনকি মৃত্যুশেষে জানাজায়ও তাকবির বলার নিয়ম।
বিজ্ঞাপন
একবার রাসুল (স.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায়কালে এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা ওয়াল হামদুলিল্লাহ কাসিরা ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওয়া আসিলা’ (অর্থ: আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর। আর সকাল ও সন্ধ্যায় তারই পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে)।
নামাজ শেষে রাসুল (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ কথাগুলো কে বলল? সবার মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি বলেছি। তখন রাসুল (স.) বললেন, কথাগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ কথাগুলোর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। (সহিহ মুসলিম: ১২৪৫)
আল্লাহ তাআলা বলছেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হেদায়াত দিয়েছেন, সেজন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা বাকারা: ১৮৫)
তাকবিরের উপকার
১. শয়তান পালায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন—
শয়তান যখন সালাতের আজান তথা (আল্লাহু আকবর আওয়াজ) শুনতে পায়, তখন বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালাতে থাকে, যেন আজানের শব্দ তার কানে পৌঁছতে না পারে। মুয়াজ্জিন যখন আজান শেষ করে তখন সে ফিরে এসে (সালাত আদায়কারীর) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। সে পুনরায় যখন ইকামাত শুনতে পায়, আবার চলে যায় যেন এর শব্দ তার কানে না যেতে পারে। যখন ইকামাত শেষ হয় তখন সে ফিরে এসে (সালাত আদায়কারীদের অন্তরে) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। (মুসলিম: ৭৪২ )
২. যুদ্ধাবস্থায় সুন্নত
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) অতি সকালে খায়বার প্রান্তরে প্রবেশ করেন। সেসময় ইহুদিরা কাঁধে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা যখন তাকে দেখতে পেল, তখন বলতে লাগল, মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে, মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে, ফলে তারা দুর্গে ঢুকে পড়ল। তখন আল্লাহর রাসুল (স.) তার উভয় হাত তুলে বললেন—
‘আল্লাহু আকবর, খায়বার ধ্বংস হোক।’ (বুখারি: ২৯৯১)
৩. খুশির সংবাদে সুন্নত
সাহাবায়ে কেরাম খুশির সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলতেন। সহিহ বুখারির এক দীর্ঘ বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার সাহাবাদের বলেন, আমি আশা করি, তোমরা সব জান্নাতবাসীর এক-তৃতীয়াংশ হবে। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ (রা.) বলেন, তখন আমরা এ সংবাদ শুনে আবার আল্লাহু আকবর বলে তাকবির দিলাম। তিনি আবার বলেন, আমি আশা করি, তোমরা সব জান্নাতির অর্ধেক হবে। এ কথা শুনে আমরা আবারও আল্লাহু আকবর বলে তাকবির দিলাম। তিনি বলেন—
তোমরা তো অন্য মানুষের তুলনায় এমন, যেমন সাদা ষাঁড়ের দেহে কয়েকটি কালো পশম অথবা কালো ষাঁড়ের শরীরে কয়েকটি সাদা পশম। (বুখারি: ৩৩৪৮)
৪. আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে তাকবির
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো জায়গায় আগুন লাগতে দেখো, তখন আল্লাহ আকবর বলতে থাকো। কেননা তাকবির আগুন নেভাতে সহায়ক।’আরেক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (স.) বলেছেন, তোমরা আগুন নেভাতে তাকবিরের সাহায্য নাও। (মাকাসিদুল হাসানা: ৬৩)
৫. অহংকার দূর হয়
অহংকার থেকে বাঁচতে বেশি পরিমাণে তাকবির বা আল্লাহু আকবার পাঠ করা জরুরি। কারণ, মুমিনের অন্তরে যখন আল্লাহর বড়ত্ব দৃঢ়ভাবে স্থাপন হবে, তখন সব অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তর পবিত্রতা লাভ করবে। আর এটিই আল্লাহু আকবারের সবচেয়ে বড় প্রভাব। আর অহংকারী না হতে স্বয়ং আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন।
‘পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না। কেননা তুমি তো কখনোই পদভারে পৃথিবী বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর উচ্চতায় কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩৭)
৬. অন্যায় থেকে বাঁচতে
আল্লাহু আকবার ‘শাআইরে ইসলাম’ বা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি এর মর্যাদা রক্ষা করবে সে ইনশাআল্লাহ সব ধরনের গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবে। অন্তরে সত্যিকার অর্থে আল্লাহর সম্মান ও ভয় থাকলে কখনো গুনাহে লিপ্ত হওয়া যায় না। আর তাকবিরের মর্মার্থ—আল্লাহর মহত্বের গীত গাওয়া। আল্লাহভীতি অর্জনে তাকবির ভালো কাজ দেয়। ইরশাদ হয়েছে—
‘আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।’ (সুরা হজ: ৩২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বেশি তাকবির তথা আল্লাহু আকবার তথা তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।