জ্বিনের অস্তিত্ব স্বীকার করা ঈমান বিল গায়েব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত। জ্বিন শব্দের অর্থ গুপ্ত, অদৃশ্য, লুক্কায়িত, আবৃত প্রভৃতি। এরা আল্লাহ তাআলার এমন সৃষ্টি, যারা মানুষের অন্তরালে থাকে। মানুষের আগে জ্বিনজাতির সৃষ্টি, তাদের ইসলাম গ্রহণ, তাদের প্রকারভেদ, জীবনাচার ইত্যাদি বিষয়ে কোরআন-হাদিসের অনেক দলিল রয়েছে। জ্বিনজাতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ ‘সুরা জ্বিন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও নাজিল করেছেন। তাই জ্বিনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা কোরআন অস্বীকার করার নামান্তর।
কেউ মুসলিম হয়েও পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের উদ্দেশে এ বিষয়ে সত্য অস্বীকার করে বসে। তাদের জানা উচিত- মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা থেকে জ্বিন সৃষ্টি করেছি’ (সুরা হিজর: ২৭)। ‘ওহে মানুষ ও জিন, আমি কি যুগে যুগে তোমাদের কাছে নবী প্রেরণ করিনি...?’ (সুরা আনআম: ৩০)। ‘যারা সুদ খায় তারা কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দণ্ডায়মান হবে, যেমন শয়তানের আছর (কুপ্রভাব) কাউকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলে।’ (সুরা বাকারা: ২৭৫)
বিজ্ঞাপন
জ্বিনের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য শুধুমাত্র একটি আয়াতই যেখানে যথেষ্ট, সেখানে আল্লাহ তাআলা প্রায় ৫০ বারেরও বেশি জ্বিন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমি একদল জ্বিনকে আপনার (অর্থাৎ মুহাম্মদের) প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা কোরআন পাঠ শুনছিল। তারা যখন কোরআন পাঠের জায়গায় উপস্থিত হলো, তখন পরস্পর বলল- চুপ থাকো। অতঃপর যখন পাঠ সমাপ্ত হলো, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে (জ্বিন সম্প্রদায়) সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল।’ (সুরা আহকাফ: ২৯)
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, আমার প্রতি ওহি নাজিল করা হয়েছে যে, জ্বিনদের একটি দল কোরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছে- আমরা বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি’ (সুরা জ্বিন: ১)। ‘আর এই যে মানুষের মধ্যে কিছু লোক জ্বিন জাতির কিছু লোকের আশ্রয় নিত, ফলে ওরা তাদের পাপাচার বাড়িয়ে দিত’ (সূরা জ্বিন: ৬)। ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত: ৫)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘ফেরেশতারা আলোর তৈরি, জ্বিনরা আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে তৈরি এবং আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা (মাটি থেকে) পবিত্র কোরআনে রয়েছে।’ (মুসলিম: ১৮/১২৩ – তাফসির আন-নববি)
বিজ্ঞাপন
জ্বিনজাতি মানুষের মতো পুরুষ ও স্ত্রী জাতিতে বিভক্ত। হাদিসে এসেছে, ‘যে এই আয়াত (আয়াতুল কুরসি) পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত করে দিবেন এবং কোনো পুরুষ ও নারী জ্বিন-শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি: ৫০১০)
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে প্রমাণ হয় যে, জ্বিন আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তাদের অস্তিত্ব সত্য। জ্বিন জাতির সৃষ্টি হয়েছে উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। জ্বিনদের বিবেক, বুদ্ধি ও অনুভূতি শক্তি আছে। তাদের আছে ভালো ও মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা। তাদের মধ্যে রয়েছে ভালো জ্বিন ও মন্দ জ্বিন। পবিত্র কোরআনে জ্বিনদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমাদের কিছু সৎকর্মশীল ও কিছু এর ব্যতিক্রম। আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত।’ (সুরা জ্বিন: ১১)
আরও পড়ুন: ঈমানের স্বাদ পেতে হলে তিন গুণ জরুরি
আসলে বিশ্বাস বা ঈমান অদেখা বিষয়ের সাথেই সম্পর্কিত। মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তারা অদৃশ্য বা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’ (আল বাকারা: ৩)। আল্লাহ, ফেরেশতা, হাশর, কেয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয় না দেখেই বিশ্বাস করেন প্রত্যেক মুসলমান। আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করে ধূর্ত অবিশ্বাসীরা। তারা সুযোগ পেলে প্রথমে ‘জ্বিন বলতে কিছু নিই’ দিয়ে তরুণদের মনে সংশয় তৈরি করার চেষ্টা করে। পরে ফেরেশতা, জান্নাত-জাহান্নাম এমনকি আল্লাহ নিয়েও অবান্তর যুক্তির অবতারণা করে। অর্থাৎ যেগুলো ঈমানের মূল বিষয় সেগুলো মন থেকে তুলে ঈমানহারা করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তাআলা হেফাজত করুন।
বস্তুত, শুধু মুসলমান নয়, আসমানি কিতাবে যারা বিশ্বাস করেন অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টানরাও জ্বিনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কিছু দার্শনিক, পৌত্তলিক ও বস্তুবাদী গবেষকরা জ্বিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। দার্শনিকদের একটি দল এ-ও বলে থাকে যে, ফেরেশতা ও জ্বিন রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ভালো চরিত্র ফেরেশতা আর খারাপ চরিত্র জিন বা শয়তান শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়। তাদের বক্তব্য কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী।
আরও পড়ুন: যে গুনাহে ঈমান যায়, আবার ফিরে আসে
কোরআনের আয়াত অস্বীকারকারী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী; অন্তকাল সেখানে থাকবে।’ (সুরা বাকারাহ: ৩৯)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এতে সন্দেহ নেই যে, আমার আয়াতসমুহের প্রতি যেসব লোক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে, আমি তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আবার আমি তা পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আজাব আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, হেকমতের অধিকারী।’ (সুরা নিসা: ৫৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আমর বিল গায়েবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি বিষয় মনে প্রাণে বিশ্বাস করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

