রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পবিত্রতা বড় ইবাদত ও পূর্ণ ঈমানের প্রমাণ

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

পবিত্রতা বড় ইবাদত ও পূর্ণ ঈমানের প্রমাণ

ইসলাম মানুষের পূতপবিত্র জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (স.) পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ ঘোষণা করেছেন এবং নামাজসহ একাধিক ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেছে ইসলামি শরিয়ত। একাধিক আয়াত ও হাদিসে মুমিনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পবিত্র জীবন-যাপনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

পবিত্রতা দীনের ভিত্তি। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর দীনের ভিত্তি স্থাপিত।’ (মাউসুআতু আতরাফিল হাদিস আন-নাবাবি, পৃষ্ঠা-২৯৪)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘ইসলাম পরিচ্ছন্ন। সুতরাং তোমরা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করো। নিশ্চয়ই জান্নাতে কেবল পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিই প্রবেশ করবে।’ (ফাইজুল কাদির: ৩০৬৫)


বিজ্ঞাপন


পবিত্রতা নামাজ কবুলের পূর্বশর্ত। পবিত্র শরীর ও কাপড় ছাড়া ব্যক্তির নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্রতা নামাজের চাবি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৭৬)

রাসুলুল্লাহ (স.) এক হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলেছেন এবং অন্য হাদিসে ঈমানের অর্ধেক বলেছেন। আবু মালিক আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ’ (সহিহ মুসলিম: ২২৩)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘... আর পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫১৯)

আরও পড়ুন: ধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক আশুরা 

পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলার ব্যাখ্যায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া নেক কাজের অন্যতম ভিত্তি, যা রুচিশীল ব্যক্তির রুচির দাবি। বিশেষত, যার মধ্যে মালাকুতি (ফেরেশতাসুলভ) নূর প্রসার লাভ করেছে। তারা অপবিত্রতা অপছন্দ করে এবং পবিত্রতা পছন্দ করে। তাতে আনন্দ ও প্রশান্তি বোধ করে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা-১৭৩)


বিজ্ঞাপন


‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’ হাদিসের ব্যাখ্যায়—শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘এখানে ঈমান দ্বারা অন্তরের সেই অবস্থা বোঝানো হয়েছে, যা পবিত্রতা ও নম্রতার নূরের সমন্বয়ে গঠিত। ..পবিত্রতা অন্তরের অন্তর্মূলে প্রভাব বিস্তার করে। তা আত্মাকে পূতপবিত্র করে, নির্মল করে এবং তাকে ফেরেশতাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। অনেক নোংরা ও নাপাক অবস্থা বিস্মৃত করে দেয়। মূলত অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যকে অজুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা-১৭৪)

ঈমান ও ইবাদতের একটি উদ্দেশ্য মানব জীবনকে পবিত্র করা। আল্লাহ তাআলা মানুষকে পবিত্র করতে চান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ, ‘... আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না; বরং তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।’ (সুরা মায়েদা: ৬)

আল্লাহ পবিত্রতা ভালোবাসেন। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ সেসব মানুষের প্রশংসা করেছেন, যারা পবিত্র থাকতে পছন্দ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই আল্লাহভীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটাই আপনার নামাজের জন্য অধিক যোগ্য। সেখানে এমন লোক রয়েছে, যারা পবিত্রতা অর্জন করতে ভালোবাসে। আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তাওবা: ১০৮)

আরও পড়ুন: ইসলামে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব

পবিত্রতা মুমিন জীবনের সৌন্দর্য। ঈমানের পরিচায়ক। মুমিন দেহ ও মনের দিক থেকে সব সময় পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে। অপবিত্রতা থেকে নিজের দেহ-মনকে রক্ষা করবে। রাসুলুল্লাহ (স.) পবিত্রতা রক্ষায় মুমিনকে যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন, ‘প্রকৃত মুমিন ছাড়া আর কেউই অজুর প্রতি যত্নবান হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৪৩৬)

ইসলামে বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় পবিত্রতার ধারণা সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে। এ জন্য মহানবী (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন অজু করে, সে যেন ভালোভাবে অজু করে এবং বলে, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ! আমাকে তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আমাকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৫৫)

 হারাম বা নিষিদ্ধ জিনিস অপবিত্র। তাই তা দান করলে কবুল হবে না। সব ধরনের হারাম কিংবা অপবিত্র জিনিস আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ-ই কবুল হয় না। আর হারাম মালের সদকাও গৃহীত হয় না। ( মুসলিম প্রথম খণ্ড, পৃ-২০৪)

অপবিত্রতা গুনাহের কারণ। গুনাহের কাজ মানুষকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে বাঁচতে হলে, অবশ্যই আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। এজন্য নিয়মিত অজু-গোসল করতে হবে। হাত-পায়ের নখ কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে। মাথার চুল ও দাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুল (স.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বললেন- কবর দুটিতে শায়িত ব্যক্তিদের ওপর আজাব হচ্ছে। তেমন কোনো বড় কারণে এ আজাব হচ্ছে না। এদের একজনের আজাব হচ্ছে এ কারণে যে, সে প্রস্রাবের মলিনতা ও অপবিত্রতা হতে বেঁচে থাকার অথবা পবিত্র থাকার কোনো চেষ্টাই করত না। আর দ্বিতীয় জনের ওপর আজাব হওয়ার কারণ হচ্ছে, সে চোগলখুরি করত। (বুখারি: ২১৮)। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, প্রস্রাবই বেশির ভাগ কবরের আজাবের কারণ হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ: ৩৪৮)

দীনের সঙ্গে সংল্লিষ্ট পবিত্র কোনো বস্তুকে স্পর্শ করার আগেও পাক-পবিত্র হয়ে নিতে হবে। যেমন- কোরআন সবচেয়ে পবিত্র কিতাব। সবচেয়ে পবিত্র স্থান হলো মসজিদ। অপবিত্র অবস্থায় কোরআন মাজিদকে যেমন স্পর্শ করা যায় না, তেমনি অপবিত্র অবস্থায় পবিত্র কোনো স্থানেও গমন করা যায় না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় এটি মহিমান্বিত কোরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে। কেউ স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া।’ (সুরা ওয়াকেয়া: ৭৭-৭৯)

গবেষক আলেমরা পবিত্রতা অর্জনের চারটি স্তর বর্ণনা করেন। এর মধ্যে একটি হলো— নিজেকে গাইরুল্লাহ মুক্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহান আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমেই ব্যক্তি চূড়ান্ত পবিত্রতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই স্তরের পবিত্রতা শুধু নবী (আ.) ও সিদ্দিকিনরাই লাভ করতে পারেন। এই স্তর বোঝাতে সুরা আনআমের ৯২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘বলো, আল্লাহ; অতঃপর তাদের পরিত্যাগ করো।’ এটি ছাড়া বাকি তিনটি স্তর হলো— ১) বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে অপবিত্র, নোংরা বিষয় থেকে পবিত্র করা। ২) শরীরের অঙ্গগুলোর মাধ্যমে যেসব পাপ ও অন্যায় হয় তা থেকে বিরত থাকা। ৩) কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ স্বভাব থেকে নিজেকে পবিত্র করা। (আল্লামা ফায়জুল কাশানি, আসরারুল ইবাদা, পৃষ্ঠা-৬)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের এবং পবিত্র জীবন যাপনের তাওফিক দান করুক। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর