মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম। তাই অপবিত্র অবস্থায়, বিনা অজুতে তা স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। সর্বযুগের প্রায় সব আলেম এ কথার ওপর একমত যে, কোরআনুল কারিম সরাসরি স্পর্শ করতে পবিত্রতা অর্জন জরুরি। রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে এ বিধান বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম নববি ও ইমাম তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘পবিত্র হওয়া ছাড়া কোরআন স্পর্শ করা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন হজরত আলী, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, সালমান, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) প্রমুখ সাহাবি। অন্য সাহাবিদের এর বিপরীত কোনো অভিমত নেই।’ (শরহুল মুহাজ্জাব: ২/৮০; মাজমুউল ফতোয়া: ২১/২৬৬)
অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা যাবে না—এ বিধানের ক্ষেত্রে চার মাজহাবের কোনো আলেমের দ্বিমত নেই। সাহাবি-তাবেয়িরাও দ্বিমত পোষণ করেননি। তবে হ্যাঁ, বিধানটি কোরআনে কারিমের আয়াত দিয়ে প্রমাণিত নাকি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত—এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়।
আয়াতটি হলো—‘যারা পূত-পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ তা (কোরআন) স্পর্শ করে না’ (সুরা ওয়াকিয়া: ৭৯)। হজরত ইবনে আব্বাস ও আনাস (রা.) বলেন, এই আয়াত দিয়ে লওহে মাহফুজের কোরআন ও ফেরেশতা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এখানে মানুষের কথা বলা হয়নি, ফেরেশতাদের কথা বলা হয়েছে।
আর সালমান ফারসি (রা.)-সহ অনেক তাবেয়ির অভিমত হলো—এই আয়াতে জমিনে অবতীর্ণ কোরআনই উদ্দেশ্য এবং এর মাধ্যমে কোরআন স্পর্শ করতে পবিত্রতার বিধান প্রমাণিত হয়। (তাফসিরে তাবারি: ২৩/১৫০; ইবনে কাসির: ৭/৫৪৫)
লাওহে মাহফুজের কোরআন আর নাজিলকৃত কোরআনের পবিত্রতার মধ্যে যে বাস্তব অর্থে কোনো পার্থক্য নেই সে কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে কোরআন আছে, এটি সেই কোরআনই, যা লওহে মাহফুজে আছে। কোরআন কোরআনই, যদিও তা গাছের পাতা, পশুর চামড়া, পাথর বা কাগজে লেখা হয়। সুতরাং আসমানে অবস্থিত লিখিত কিতাবের হুকুম যেহেতু তা পবিত্রতা ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না, একইভাবে জমিনে থাকা কোরআনের ক্ষেত্রেও একই বিধান আবশ্যক। কেননা এ কোরআনের সম্মান সে কোরআনের মতোই। (শরহুল উমদাহ: ১/৩৮৪)
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস আছে। রাসুলুল্লাহ (স.) আমর বিন হাজম (রা.)-এর কাছে এ মর্মে চিঠি লিখেন যে, ‘পবিত্র হওয়া ছাড়া যেন কেউ কোরআন স্পর্শ না করে।’ (মুয়াত্তা মালেক: ৬৮০; সুনানে দারেমি: ২২৬৬, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ১৩২৮; সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৫৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবায়হাকি: ৪০৮)।
ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, আমার জানামতে, হাদিসটি সহিহ। (তারিখে দিমাশক: ২২/৩০৮)। ইমাম ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান (রহ.) বলেন, ‘আমর বিন হাজম (রা.)-এর এ চিঠির চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো চিঠির কথা আমার জানা নেই’ (তারিখে দিমাশক: ২২/৩০৮)। ইমাম হাকেম নাইসাবুরি (রহ.) বলেন, ‘ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ও ইমাম জুহরি (রহ.) এ চিঠির যথার্থতার সাক্ষ্য দিয়েছেন’ (আল মুসতাদরাক: ১/৩৯৭)। এছাড়া ইবনে দাদিকুল ঈদ, ইবনুল মুলাক্কিন, ইবনে কুদামা, আবদুল হক ইশবিলি (রহ.) প্রমুখ হাদিসবিশারদ সহিহ বলেছেন।
হজরত হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (স.) তাঁকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানোর সময় এ কথা বলে দিলেন, ‘পবিত্রতাবিহীন কোরআন স্পর্শ করবে না।’ (মুসতাদরাকে হাকেম: ৬০৫১, আলমুজামুল কাবির: ১৩১৩৫, সুনানে দারা কুতনি: ৪৪০) ইমাম হাকেম ও আল্লামা জাহাবি (রহ.) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) বলেছেন, ‘পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন কোরআন স্পর্শ না করে।’ (আল মুজামুল কাবির: ১৩২১৭, সুনানে দারে কুতনি: ৮৩৭, আসসুনানুল কুবরা লিলবায়হাকি: ৭২৫৫) ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘হাদিসটির সনদ বা সূত্রে কোনো সমস্যা নেই।’ (আততালখিসুল হাবির: ১/১৩১) হায়সামি (রহ.) বলেন, ‘এর সব বর্ণনাকারী গ্রহণযোগ্য।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/২৭৬)
হজরত ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, ‘রাসুল (স.) কাফেরদের দেশে কোরআন শরিফ নিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১৮৬৯) হাদিসবিশারদরা বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো—যাতে কাফেররা কোরআন শরিফ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করতে না পারে আর যেন কাফিরদের মাধ্যমে কোরআনের অবমাননা না হয়। (আলইস্তিজকার: ৫/২২)
হজরত ওমর (রা.) কাফের থাকা অবস্থায় তাঁর বোনকে কোরআন দেখাতে বলেছিলেন, তখন তাঁর বোন বলেছিলেন, ‘তুমি নাপাক! আর এ গ্রন্থ পবিত্র হওয়া ছাড়া কেউ ধরতে পারে না।’ (সুনানে দারা কুতনি: ৪৪১, আসসুনানুল কুবরা বায়হাকি: ৪১৩)
অজু ছাড়া কোরআন স্পর্শের পক্ষে যুক্তি
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, চার মাজহাব ও সব যুগের বেশির ভাগ আলেমের বিপক্ষে গিয়ে কেউ অজু ছাড়া কোরআন স্পর্শ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকেন। তাদের যুক্তি হলো—এক) হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইসতিনজা (টয়লেট) থেকে বের হয়ে বিনা অজুতে আমাদের কোরআন পড়াতেন এবং আমাদের সঙ্গে গোশত খেতেন। গোসল ফরজ হওয়া ছাড়া অন্য কিছু তাঁকে কোরআন হতে বাধা দিত না।’ (আবু দাউদ: ২২৯)
এই হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা হলো—আলোচ্য হাদিসে অপবিত্র অবস্থায় কোরআন পড়ানো বৈধ হওয়ার বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এখানে স্পর্শের কথা বলা হয়নি। তাই আগে উল্লিখিত হাদিসগুলোর আলোকে জানা যায়, অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা হারাম।
দুই) বুখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (স.) রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে যে পত্র পাঠিয়েছেন তাতে কোরআনের আয়াত লেখা হয়েছে। অথচ সে ছিল কাফির।
এর জবাব হলো, হাদিসবিশারদরা এই হাদিসের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন—যে পত্র প্রেরণের ঘটনাটি অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা নিষিদ্ধ হওয়ার আগে হয়েছিল, তাই এ বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে। (শরহে বুখারি, ইবনে বাত্তাল: ১/১৫৮)
কোনো কোনো হাদিসবিশারদ বলেছেন, এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, কোনো পত্রাদি বা অন্য কিছুতে কোরআন শরিফের আয়াত লিখলে ওই পত্রাদি অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা যাবে, যদিও আয়াত স্পর্শ করা যাবে না। এজন্যই রাসুল (সা.) আয়াতটি লিখেছিলেন। (আল মিনহাজ: ১২/১০৮)
একটি সরল যুক্তি ও তার জবাব
অনেক ভাই যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, আল কোরআন সব মানুষের হেদায়েতের জন্য নাজিল হয়েছে, তাই এর পাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। যদি কোরআন স্পর্শে পবিত্রতা শর্ত করা হয় তাহলে অমুসলিমরা যেহেতু সাধারণত নাপাক থাকে তাই তারা কোরআনের শিক্ষা ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত থাকবে। এর জবাব হলো—প্রথমত, এ কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের সামনে নিজের যুক্তি পেশ করাই হলো মূর্খতা। কেননা ইসলাম অর্থই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করা। এখন কেউ যদি আল্লাহ ও রাসুলের বিধানের বিপরীতে নিজের যুক্তি পেশ করে তাহলে তা আর যা কিছুই হোক, ইসলামের আদর্শ নয়।
দ্বিতীয়ত, অমুসলিমদের হেদায়েতের ব্যাপারে রাসুল (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম অধিক আগ্রহী ছিলেন। তা সত্ত্বেও রাসুল (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোরআন স্পর্শ করতে পবিত্রতার বিধান বর্ণিত হয়েছে। উপরে উল্লিখিত ওমর (রা.) ও তাঁর বোনের মধ্যকার ঘটনাটি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কেননা তাঁর বোন হেদায়াতের প্রতি আগ্রহী হয়েও তাঁকে অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করতে দেননি। আসলে হেদায়েতপ্রত্যাশী লোকদের জন্য এ বিধান কোনো বাধা নয়;
বরং এতে অমুসলিমদের সামনে কোরআনের মহত্ত্ব প্রকাশ পায় যে দুনিয়ার কোনো বই স্পর্শে পবিত্রতা শর্ত নয়, একমাত্র আল্লাহর পবিত্র কালাম কোরআন স্পর্শ করতেই পবিত্রতার বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, অমুসলিমদের দাওয়াতের খাতিরে একান্ত প্রয়োজনে অনন্যোপায় হলে তা বৈধ। অমুসলিমরা কোরআনের অবমাননা করলে মুসলমানরাও কি তা করবে?
মাসয়ালা
অপবিত্র অবস্থায় কোরআন সরাসরি স্পর্শ না করে কোনো অপরিহিত কাপড় ইত্যাদি দ্বারা স্পর্শ করা জায়েজ। তবে পরিহিত কাপড় দ্বারা স্পর্শ করা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার: ১/১৭৪)
কোরআন শরিফের ওপর যদি এমন কোনো গিলাফ বা মলাট থাকে, যা কোরআন শরিফের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাহলে তার ওপর স্পর্শ করা যাবে। (ফাতহুল কদির: ১/১৪৯)
মোবাইলে বা আই-প্যাডের স্ক্রিনে কোরআনের সুরা বা আয়াত দৃশ্যমান থাকলে আয়াতের উপর অজু ছাড়া স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে স্ক্রিনের যে অংশে আয়াত লেখা থাকবে না সে অংশে হাত লাগাতে পারবে। (‘রদ্দুল মুহতার: ১/১৭৩; হাশিয়াতুত তাহতাবি আলাল মারাকি: পৃ-৭৭)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআনের পবিত্রতা রক্ষায় সচেতনতা দান করুন। দীনের প্রতিটি সুস্পষ্ট বিষয়ে উম্মাহর অন্তরে ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’ নীতি জাগ্রত করুন। আমিন।