পবিত্র নগরী মদিনা। মুসলিম উম্মাহর কাছে মক্কার পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান। এটি ইসলামের শক্তিকেন্দ্র, যেখান থেকে বিশ্বব্যাপী হেদায়াতের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। মক্কা থেকে হিজরত করার পর মহানবী (স.) এখানেই তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শেষ ১০ বছর কাটিয়েছেন। মূলত আল্লাহ তাআলা এই নগরীকে ইসলামের জন্য কবুল করেছিলেন। এই মাটির বুকেই পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন বিশ্বনবী (স.)। তাই মুমিনের হৃদয়ে এই নগরীর প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আবেগ।
মদিনার নাম ও পরিচিতি
ইসলামের ইতিহাসে মদিনার বহুবিধ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লামা সামহুদির মতে, মদিনার প্রায় ৯৪টি নাম রয়েছে। এর মধ্যে ‘মদিনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে এই নামটি ৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে। (সুরা তাওবা: ১০১ ও ১২০; সুরা আহজাব: ৬০; সুরা মুনাফিকুন: ৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) এই নগরীকে ‘তাবাহ’ বা ‘তাইবাহ’ নামে অভিহিত করেছেন, যার অর্থ ‘উত্তম’ বা ‘পবিত্র’। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা এই মদিনাকে ‘তাবাহ’ নামে নামকরণ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৭২)
জাহেলি যুগে এই শহরের নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হিজরতের পর এই নাম বিলুপ্ত হয়ে নতুন নাম হয় মদিনা মুনাওয়ারা, মদিনাতুল রাসুল বা মদিনাতুন নববি।
আরও পড়ুন: কোরআনের আলোকে মক্কা নগরীর মর্যাদা
কোরআন ও হাদিসের আলোকে মদিনার মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল (স.) পবিত্র এই নগরের বহুবিধ মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। এর প্রধান কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো-
১. নবীর ভালোবাসার শহর
মাতৃভূমি মক্কার প্রতি রাসুল (স.)-এর ভালোবাসা ছিল অগাধ, কিন্তু মদিনার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল বিশেষ আকুতিপূর্ণ। তিনি দোয়া করতেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি মদিনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দাও, যেমনিভাবে প্রিয় করেছ মক্কাকে, বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করো।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৮৯)
২. দাজ্জাল ও মহামারি থেকে সুরক্ষিত
কেয়ামতের আগে দাজ্জালের ফিতনা থেকে মদিনা মুক্ত থাকবে। আল্লাহ তাআলা মদিনার প্রবেশদ্বারগুলোতে ফেরেশতা পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন। রাসুল (স.) বলেন, ‘মদিনার পথে-প্রান্তরে রয়েছে (প্রহরী) ফেরেশতারা, (তাই) এখানে মহামারি ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৮০)
৩. বরকতময় জনপদ
মদিনার রিজিকে ও ফলফলাদিতে বরকতের জন্য নবীজি (স.) বিশেষ দোয়া করেছেন। তিনি বলতেন- ‘হে আল্লাহ! মক্কায় যতটুকু বরকত রয়েছে, মদিনায় তার সমান বা দ্বিগুণ বরকত দাও।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৩৯২)
৪. ঈমানের আশ্রয়স্থল
পৃথিবীতে যখন ঈমানের ওপর টিকে থাকা কঠিন হবে, তখন মদিনাই হবে মুমিনদের শেষ আশ্রয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘ঈমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৭৬)
আরও পড়ুন: যে শহরে পাপ করলে রেহাই নেই
৫. মসজিদে নববি ও রওজা শরিফ
এই শহরেই অবস্থিত মসজিদে নববি। এখানে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে মক্কার মসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য যেকোনো মসজিদের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। আর এই মসজিদের ভেতরেই রয়েছে জান্নাতের এক টুকরো বাগিচা। রাসুল (স.) বলেন, ‘আমার মিম্বার ও ঘরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচাগুলোর একটি।’ (সহিহ বুখারি: ১১৯৫)
৬. মদিনায় মৃত্যুবরণের ফজিলত
মদিনার মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা মুমিনের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। রাসুল (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন তা করে। কেননা যে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত করব।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৫৮১৮)
৭. মদিনার সম্মান সংরক্ষিত (হারাম)
মদিনাকে শরিয়ত ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করেছে। হারাম শব্দের একটি অর্থ নিষিদ্ধ এবং আরেকটি পবিত্র। দুটি অর্থই এ নগরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাসুল (স.) বলেন, ‘মদিনার আইর ও সওর পর্বতের মাঝখানের স্থানটুকু হারাম।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৩৯৩)
৮. জ্ঞানচর্চার মর্যাদা
মদিনা ছিল ইসলামের প্রথম বিদ্যালয়, যেখানে মহানবী (স.) এমন একটি প্রজন্মকে প্রস্তুত করেছিলেন, যাদের হাতে তিনি ইসলামের আমানত তুলে দেন। ইসলামি জ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে মদিনার রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। রাসুল (স.) বলেন, ‘মানুষ হন্যে হয়ে ইলম অনুসন্ধান করবে, তবে মদিনার আলেমের চেয়ে অধিক বিজ্ঞ কোনো আলেম তারা খুঁজে পাবে না।’ (সুনানে নাসায়ি: ৪২৭৭)
আরও পড়ুন: রিয়াজুল জান্নাহ: পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাত
মদিনায় করণীয় ও বর্জনীয়
মদিনার সম্মান রক্ষা করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। এই পবিত্র নগরীতে অবস্থানের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। সেগুলো হলো—
সুন্নাহ অনুসরণ: মদিনায় আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নববী আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা।
পাপাচার থেকে বিরত থাকা: মদিনায় পাপ কাজ করা বা পাপাচারীকে আশ্রয় দেওয়া জঘন্য অপরাধ। রাসুল (স.) সতর্ক করেছেন যে, মদিনায় বিদআত বা পাপ কাজকারীর ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়।
মদিনাবাসীকে কষ্ট না দেওয়া: মদিনার বাসিন্দাদের সম্মান করা জরুরি। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই নগরীর অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ তাকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে যায়।’ (সহিহ মুসলিম: ৩৪২৪)
ধৈর্য ধারণ: মদিনায় বসবাসকালীন দুঃখ-কষ্ট বা অভাব-অনটনে ধৈর্য ধারণ করার প্রতি নবীজি (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন।
মদিনা শুধু একটি শহর নয়, এটি ইসলামি সংস্কৃতি ও চেতনার প্রাণকেন্দ্র। কেয়ামত পর্যন্ত এই নগরী তার পবিত্রতা বজায় রাখবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র মদিনার সম্মান রক্ষা করার এবং রাসুল (স.)-এর রওজা জিয়ারত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

