ইতিহাসের এক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের সমাধান হয়েছিল সম্পূর্ণ অলৌকিক পদ্ধতিতে। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় ও দীর্ঘতম সুরা বাকারার ৬৭ থেকে ৭৩ নং আয়াতে বিস্তারিত বর্ণিত সেই বিস্ময়কর ঘটনায় একটি গরু জবাই করে তার অংশবিশেষ দিয়ে মৃতদেহ স্পর্শ করাতেই নিহত ব্যক্তি আল্লাহর কুদরতে জীবিত হয়ে ওঠে এবং নিজ হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করে দেয়। এই ঘটনায় আল্লাহ তাআলার অসীম ক্ষমতা, মানুষের অবাধ্য মানসিকতার পরিণতি এবং নিঃশর্ত আনুগত্যের গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
ঘটনার সূত্রপাত
বনি ইসরাইলের এক ধনী ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিহত হন। কে তাকে হত্যা করেছে এ নিয়ে সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পরের ওপর দোষারোপ করতে থাকে। ক্রমে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি রক্তারক্তির দিকে এগোয়। অবশেষে এই গুরুতর বিবাদের মীমাংসার জন্য তারা আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.)-এর শরণাপন্ন হয়।
আল্লাহর অপ্রত্যাশিত নির্দেশ
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি লাভ করে জনগণকে জানান- একটি গরু জবাই করতে হবে। এরপর জবাইকৃত গরুর একটি অংশ দিয়ে নিহত ব্যক্তির দেহে আঘাত করা হলে সে জীবিত হয়ে হত্যাকারীর পরিচয় প্রকাশ করবে।
আরও পড়ুন: ১০০ বছর পর জীবিত হয়েছিলেন যে নবী
বিজ্ঞাপন
এই নির্দেশ ছিল মানুষের চিন্তার সীমার বাইরে। তাই বনি ইসরাইল প্রথমে তা উপহাসের সুরে গ্রহণ করে এবং নবী মুসা (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন তোলে- তিনি কি তাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন? মুসা (আ.) দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন, আল্লাহর নবীরা কখনো ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেন না; বরং আল্লাহর নির্দেশই তিনি তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
অহেতুক প্রশ্ন ও জটিলতা সৃষ্টি
আল্লাহর আদেশ সহজভাবে পালন করার পরিবর্তে বনি ইসরাইল গরুটির বয়স, রং ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। তাদের এই জিদ ও টালবাহানার ফলেই আল্লাহ তাআলা গরুটির বিবরণ ক্রমে আরও নির্দিষ্ট করে দেন- গরুটি হবে মধ্য বয়সী, গাঢ় হলুদ বর্ণের, সুদর্শন এবং কোনো কাজে ব্যবহৃত নয়।
ফলে একটি সাধারণ নির্দেশ পরিণত হয় অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়বহুল এক দায়িত্বে। শেষ পর্যন্ত তারা এমন একটি দুর্লভ গরুর সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, যা পাওয়া যায় এক দরিদ্র কিন্তু অতিশয় মাতৃভক্ত যুবকের কাছে, যার কাছে মায়ের নির্দেশের চেয়ে অধিক মূল্যবান কিছুই ছিল না।
অলৌকিক সমাধান
অবশেষে বনি ইসরাইল ওই যুবকের কাছ থেকে তার মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী বিপুল অর্থের বিনিময়ে গরুটি সংগ্রহ করে জবাই করে। এরপর আল্লাহর নির্দেশ মেনে গরুর একটি অংশ নিহত ব্যক্তির দেহে স্পর্শ করানো হয়।
আরও পড়ুন: মেরাজ: সাত আসমান পেরিয়ে আল্লাহর দিদার লাভের অসাধারণ ঘটনা
ঠিক তখনই ঘটে বিস্ময়কর ঘটনা। নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে ঘোষণা করে দেয় যে, তার নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রই তাকে হত্যা করেছে। এই সত্য প্রকাশের পর সে আবার মৃত্যুবরণ করে।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘অতঃপর আমি বললাম, এর (জবাইকৃত গরুর) এক অংশ দ্বারা তাকে আঘাত করো। এভাবেই আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা অনুধাবন করো।’ (সুরা বাকারা: ৭৩)
এভাবেই একটি জটিল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয় এবং হত্যাকারী তার প্রাপ্য শাস্তির মুখোমুখি হয়।
ঘটনার গভীর শিক্ষা
এই ঘটনায় কোরআন মানবজাতির জন্য কয়েকটি চিরন্তন শিক্ষা তুলে ধরে-
১. আল্লাহ সর্বশক্তিমান: তিনি চাইলে মৃতকেও জীবিত করতে পারেন।
২. আনুগত্যই মুক্তির পথ: আল্লাহর নির্দেশে অহেতুক প্রশ্ন ও টালবাহানা কাজকে সহজ না করে বরং কঠিন করে তোলে।
৩. কোনো অপরাধ গোপন থাকে না: আল্লাহ যেকোনো উপায়ে সত্য প্রকাশ করেন।
৪. নৈতিক ইঙ্গিত: অনেক তাফসিরবিদের মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে বনি ইসরাইলের গরু-কেন্দ্রিক মানসিকতার প্রতিও পরোক্ষ আঘাত করা হয়েছে।
৫. মাতৃভক্তির মর্যাদা: গরুটির মালিক দরিদ্র যুবকের প্রতি আল্লাহর বিশেষ সাহায্য প্রমাণ করে, পিতা-মাতার আনুগত্য দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ বয়ে আনে।
সুরা আল-বাকারার এই আশ্চর্য ঘটনা শুধু অলৌকিক নিদর্শন নয়; বরং এটি সব যুগের মানুষের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। আল্লাহর আদেশে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, তাঁর অসীম ক্ষমতার প্রতি আস্থা এবং গোপন পাপ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা এতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
আজকের যুগেও, যখন মানুষ সন্দেহ ও অজুহাতে সত্য থেকে দূরে সরে যায়, তখন এই কোরআনি ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সরল আনুগত্যই শান্তি, ন্যায় ও সমাধানের একমাত্র পথ।

