জুমার নামাজের খুতবা মুসল্লিদের জন্য গভীর মনোযোগ, নীরবতা ও শ্রবণের সময়। এ সময় অনর্থক কথা বলা ইসলামি শরিয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তবে বাস্তব জীবনে অনেক অভিভাবক শিশু সন্তান নিয়ে জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করেন। ছোট শিশুরা খুতবার সময় অস্থিরতা, কান্না বা দুষ্টামি করতে পারে। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- খুতবার সময় কথা বলা নিষিদ্ধ হলেও, ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে শিশুকে শান্ত করা যাবে?
হাদিসের আলোকে মূল বিধান
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘জুমার দিন খুতবা চলাকালে যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো- ‘চুপ করো’, তবে তুমি অনর্থক কাজ করলে।’ (সহিহ বুখারি: ৯৩৪, সহিহ মুসলিম: ৯৩১) এই হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় মুখে শব্দ করে কথা বলা, এমনকি ভালো উদ্দেশ্যেও নিষিদ্ধ। কারণ এতে খুতবার মর্যাদা ও শ্রবণের আদব ক্ষুণ্ন হয়।
আরও পড়ুন: জুমার খুতবা শোনার ফজিলত: যা বারবার স্মরণ করিয়েছেন নবীজি
ইশারা-ইঙ্গিত কি কথাবার্তার অন্তর্ভুক্ত?
ফিকহবিদদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হাদিসে নিষেধাজ্ঞাটি শাব্দিক কথোপকথনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইশারা-ইঙ্গিতের ক্ষেত্রে নয়। ফিকহে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো- ইশারা ‘কালাম’ বা কথা বলার অন্তর্ভুক্ত নয়। হানাফি ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েক-এ ইমাম ইবনে নুজাইম (রহ.) বলেন- ‘ইশারা করা কথা বলার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আল-বাহরুর রায়েক: ২/১৫৬) অনুরূপভাবে ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে উল্লেখ রয়েছে- ‘খুতবার সময় মুখে কথা বলা নিষেধ; তবে মাথা বা হাতের ইশারায় কাউকে নিষেধ করা জায়েজ।’ (ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/১৪৭) আল-মুহিত আল-বুরহানিতে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে এসেছে- ‘যদি কেউ মুখে কথা না বলে, বরং মাথা, হাত বা চোখের ইশারায় কোনো নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিষেধ করে বা কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় বুঝিয়ে দেয়, তবে তা মাকরুহ নয়।’ (আল-মুহিতুল বুরহানি: ২/৪৬১)
বিজ্ঞাপন
শিশুকে ইশারায় শান্ত করার বিধান
এই ফিকহি মূলনীতির আলোকে ওলামায়ে কেরাম ব্যাখ্যা করেছেন- খুতবার সময় শিশু বা অন্য কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করলে, তাকে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে শান্ত করানো জায়েজ। কারণ এটি কথাবার্তার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং খুতবার আদবের পরিপন্থীও নয়। এই নীতির সমর্থন হানাফি ফিকহের আরও একাধিক মুতাবার গ্রন্থে পাওয়া যায়। যেমন খুলাসাতুল ফতোয়া, মুজতাবা (যাহেদি), আততাজনিস ওয়াল মাজিদ ও শরহুল মুনইয়া। এসব কিতাবে খুতবার সময় ইশারা জায়েজ হওয়ার বিধান আলোচিত হয়েছে, যার ভিত্তিতেই এ ধরনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইশারা করার অনুমতি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
আরও পড়ুন: জুমার দিন ইমামের কাছাকাছি বসার ফজিলত
শিশুকে নিয়ে মসজিদে আসার আদব
তবে এই অনুমতির পাশাপাশি ওলামায়ে কেরাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সতর্ক করেছেন। যে শিশু এখনো নামাজ ও খুতবার আদব বোঝার বয়সে পৌঁছায়নি এবং যার কারণে মুসল্লিদের ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থাকে, তাকে মসজিদে আনার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শিশুকে প্রথমে ঘরে নামাজের আদব শেখানো, মসজিদের পরিবেশের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি করা এবং ধীরে ধীরে তাকে অভ্যস্ত করানোই উত্তম পন্থা।
সারকথা হলো- জুমার খুতবার সময় মুখে শব্দ করে ‘চুপ করো’ বলা নিষিদ্ধ হলেও প্রয়োজনবশত ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে শিশুকে শান্ত করানো শরিয়তসম্মত ও জায়েজ। কারণ এটি কথাবার্তার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং খুতবার আদবের পরিপন্থীও নয়। একইসঙ্গে মুসল্লিদের দায়িত্ব হলো মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করা, অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটানো এবং সন্তানদের ইসলামের আদব ও শালীনতা ধীরে ধীরে শেখানো।
(আল-বাহরুর রায়েক: ২/১৫৬; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৪৭; আল-মুহিতুল বুরহানি: ২/৪৬১; খুলাসাতুল ফতোয়া: ১/২০৬; আততাজনিস ওয়াল মাজিদ: ২/২২৩; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৬০)

