রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইসলামিক কার্টুন বানিয়ে ইউটিউব থেকে আয়: শরয়ি বিধান ও শর্তাবলি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামিক কার্টুন বানিয়ে ইউটিউব থেকে আয়: শরয়ী বিধান ও শর্তাবলী

ডিজিটাল যুগে ইসলামিক শিক্ষামূলক কার্টুন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। শিশুদের আকিদা, আখলাক, দোয়া, সহিহ ঘটনা ও নৈতিকতা সহজভাবে বোঝাতে অ্যানিমেশন অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। তবে প্রশ্ন আসে- ইসলামিক কার্টুন বানিয়ে ইউটিউব থেকে আয় করা কি শরিয়তসম্মত? যদি হ্যাঁ হয়, তার শর্তাবলি কী? কোরআন-সুন্নাহ এবং নির্ভরযোগ্য ফিকহি আলোচনার আলোকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হলো।

উপার্জনের শরয়ি মূলনীতি

ইসলামে উপার্জন হালাল হওয়ার জন্য দুটি মৌলিক শর্ত রয়েছে। প্রথমত, কাজটি নিজে যেন হারাম না হয়- অর্থাৎ জুয়া, সুদ, প্রতারণা, অশ্লীলতা, গীবত, শিরক বা নিষিদ্ধ শিল্পে সম্পৃক্ত না হয়। দ্বিতীয়ত, উপার্জনের উৎস যেন হারাম কার্যক্রমে যুক্ত না হয়। তাই কনটেন্ট নির্মাণ হালাল হলেও যদি কোনো উৎসের মাধ্যমে হারাম উপাদান যুক্ত হয়, তাহলে আয়ের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। ফিকহি নীতিমালা হলো- ‘যে পণ্য হারাম, তার প্রচার করা বা তার মাধ্যমে আয় করা জায়েজ নয়।’ (কিতাবুল আছল: ৪/২০)

অ্যানিমেশন ও কার্টুনের শরয়ি অবস্থান

হাদিসে বাস্তব প্রাণীর হুবহু প্রতিকৃতি তৈরির নিষেধাজ্ঞা এসেছে। নবী (স.) বলেছেন- ‘যারা ছবি আঁকে, কেয়ামতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং বলা হবে- তোমরা যাদের ছবি বানিয়েছিলে তাদের প্রাণ দাও।’ (সহিহ বুখারি: ৫৯৫১)

তবে ফুকাহারা স্পষ্ট করেছেন- এই নিষেধাজ্ঞা মূলত সেইসব বাস্তবধর্মী প্রতিকৃতির ক্ষেত্রে, যেগুলোর সঙ্গে মূর্তি বা পূজার সম্ভাবনা ছিল। বর্তমান যুগের কার্টুনধর্মী অবাস্তব, অপ্রাণবন্ত 2D চরিত্র- যেগুলো বাস্তব মানুষের হুবহু অনুকরণ নয়, এগুলোকে অনেক আলেম বৈধ বলেছেন। শাইখ সালিহ আল-ফাওজান, শাইখ সালিহ আল-উসাইমিন এবং সৌদি আরবের স্থায়ী কমিটির মতে শিশুদের কার্টুন, অবাস্তব চরিত্র ও খেলনা-জাতীয় চিত্র নিষিদ্ধ ‘তাসউইর’ এর আওতায় পড়ে না। ড. ইউসুফ আল কারদাভিও নৈতিকতা শিক্ষামূলক অ্যানিমেশন তৈরিকে প্রশংসনীয় বলেছেন।


বিজ্ঞাপন


ফলে শিক্ষামূলক ইসলামিক কার্টুন তৈরি শরিয়তসম্মত- যদি তাতে হারাম উপাদান না থাকে।

আরও পড়ুন: হারাম উপার্জনের ৭টি বড় শাস্তি

কার্টুন তৈরির শরয়ি শর্তাবলি

ইসলামিক কার্টুনে বাস্তব মানুষের হুবহু আকৃতি এড়িয়ে কল্পনাধর্মী বা সরলীকৃত স্টাইল ব্যবহার করা উত্তম। ব্যাকগ্রাউন্ডে হারাম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা নিষিদ্ধ; বিকল্প হিসেবে নাশিদ, প্রাকৃতিক শব্দ বা হালাল সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করা যায়। বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ সহিহ হতে হবে। মনগড়া কাহিনি, ভুল হাদিস বা শিরক-বিদআত বিষয় পরিহার করতে হবে। নারী চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাবে না যাতে ফিতনার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া কনটেন্ট নির্মাতার উদ্দেশ্য হতে হবে দাওয়াত, শিক্ষা ও চরিত্র গঠন।

ইউটিউব বিজ্ঞাপন আয়ের শরয়ি ঝুঁকি

ইউটিউব বিজ্ঞাপন আয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- বিজ্ঞাপনদাতা বা কনটেন্ট নির্মাতা বিজ্ঞাপনের ধরন, কোম্পানি বা চিত্র পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ইউটিউব তার ইচ্ছামতো বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে- যার মধ্যে সুদভিত্তিক ব্যাংক, অ্যালকোহল, হারাম প্রসাধনী, অশ্লীল চিত্র বা বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থাকতে পারে।

ফিকহি দৃষ্টিতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বৈধ আয় তিনটি শর্তের ওপর নির্ভরশীল- বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু হালাল হওয়া, চিত্র-উপস্থাপনা শরিয়তসম্মত হওয়া এবং প্রচারণায় কোনো প্রতারণা না থাকা। ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব বাদায়েউস সানায়ে (৪/৪৪৬) এবং ফিকহুন নাওয়াজিল (৩/২৮৪)-এ উল্লেখ আছে যে বাছবিচারহীনভাবে যেকোনো পণ্য প্রচার করে অর্থগ্রহণ বৈধ নয়। পণ্য, বার্তা ও চিত্র অবশ্যই শরিয়তসম্মত হতে হবে। যখন নির্মাতার হাতে এসব নিয়ন্ত্রণ থাকে না, যেমন ইউটিউব বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে হয়, তখন আয়ের বৈধতা সন্দেহের মধ্যে পড়ে।

আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামি প্রচারণা: ইনফ্লুয়েন্সার না আলেম?

তাই বহু আলেম বলেন- যে বিজ্ঞাপন আপনি বাছাই করতে পারবেন না, সে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় করা নিরাপদ নয়। তবে এই ঝুঁকি কিছুটা কমানোর জন্য ইউটিউবের ‘Made for Kids’ অপশন সক্রিয় করা, অ্যাডসেন্সে কন্টেন্ট রেটিংস সঠিকভাবে সেট করা, রিস্ট্রিক্টেড মোড চালু করা এবং বিজ্ঞাপন ফিল্টার সেটিংস ব্যবহার করা যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে প্যাট্রিয়ন বা নির্দিষ্ট স্পনসরশিপের মতো সরাসরি হালাল ফান্ডিং মডেলও বিবেচনা করা যায়।

ইউটিউব থেকে আয় কি বৈধ?

শর্ত পূরণ করলে বৈধ। অর্থাৎ কার্টুনের কনটেন্ট ও বার্তা সম্পূর্ণ হালাল হতে হবে, হারাম মিউজিক বা অশ্লীলতা থাকবে না, বিজ্ঞাপন যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিত থাকবে, ভুল হাদিস বা ইসলামবিরোধী উপাদান থাকবে না, অপ্রাণবন্ত অবাস্তব কার্টুনশৈলী ব্যবহার করা হবে এবং মূল উদ্দেশ্য দাওয়াত ও নৈতিক শিক্ষা হবে।

এভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ইসলামিক কার্টুন তৈরি করে আয় করাকে অনেক আলেম বৈধ বলেছেন। তাদের মতে, এটি হালাল রুজির একটি আধুনিক পথ এবং দাওয়াতের কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর